গৌড়রাজমালা।
প্রাচীন রাজবংশ-সমুদ্ভব ছিলেন; এবং কামরূপ ত্যাগ করিয়া, কামরূপের পূর্ব্ব সীমান্ত করতোয়া নদী পার হইয়া, গৌড়ে আসিয়া, যশোবর্ম্মার সাম্রাজ্যের অধঃপতনজনিত উত্তরাপথব্যাপী বিপ্লবের সময়, গৌড়, উৎকল, কলিঙ্গ এবং দক্ষিণ কোশল লইয়া, এক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিবার অবসর পাইয়াছিলেন।
রাজতরঙ্গিণীতে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর চতুর্থপাদের আরম্ভে, বাঙ্গলায় আর একটি অভিনব রাজবংশ-প্রতিষ্ঠার বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। কহ্লণ লিখিয়াছেন—ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় কাশ্মীরের সিংহাসনে আরোহন করিয়াই,[১] বৃহৎ একদল সেনা লইয়া, পিতামহের ন্যায় দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়াছিলেন। জয়াপীড় কাশ্মীর হইতে সরিয়া গেলে, তদীয় শ্যালক জজ্জ বলপূর্ব্বক সিংহাসন অধিকার করিয়ছিলেন। তৎপর সৈন্যগণও জয়াপীড়কে পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমে ক্রমে স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিল। তখন তিনি সঙ্গী সামন্তরাজগণকে বিদায় দিয়া, অল্প কিছু সৈন্য লইয়া, প্রয়াগ গমন করিয়াছিলেন; এবং তথা হইতে একাকী ছদ্মবেশে বহির্গত হইয়া, ক্রমে পৌণ্ড্রবর্দ্ধন-নগরে উপনীত হইয়াছিলেন। পৌণ্ড্রবর্দ্ধন তখন “গৌড়রাজাশ্রিত” এবং জয়ন্ত-নামক সামন্ত নৃপতির রক্ষণাধীনে ছিল।[২] জয়াপীড় “সৌরাজ্য” (সুশাসিত) এবং “পৌরবিভূতি”-ভূষিত পৌণ্ড্রবর্দ্ধনে এক নর্ত্তকীর গৃহে আশ্রয় লইলেন; এবং একটি সিংহ-হত্যা করিয়া, আত্মপ্রকাশ করিতে বাধ্য হইলেন। তখন রাজা জয়ন্ত জয়াপীড়ের সহিত স্বীয় দুহিতা কল্যাণদেবীর বিবাহ দিলেন। “জয়াপীড় বিনা আয়োজনে গৌড়ের পাঁচজন নরপালকে পরাজিত করিয়া, শ্বশুরকে গৌড়াধীশের আসনে প্রতিষ্ঠাপিত করিয়া, পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন।”[৩] যতদিন না সমসাময়িক লিপিতে বা সাহিত্যে জয়ন্তের নামোল্লেখ দৃষ্ট হয়, ততদিন জয়ন্ত প্রকৃত ঐতিহাসিক-ব্যক্তি, কিম্বা জয়াপীড়ের অজ্ঞাতবাস-উপন্যাসের উপনায়ক মাত্র, তাহা বলা কঠিন।[৪]
- ↑ কহ্লণের মতানুসারে ৭৫১ খৃষ্টাব্দে জয়াপীড়ের রাজ্যলাভ নির্দ্ধারণ করিতে হয়। কিন্তু ষ্টিন দেখাইয়াছেন, ইহার প্রায় ২৫ বৎসর পরে জয়াপীড় প্রকৃত প্রস্তাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
- ↑ गौड़राजाश्रयं गुप्तं जयन्ताख्येन भूभूजा।
प्रविवेश क्रमेणाथ नगरं पौण्ड्रवर्द्धनं॥ (४।४२१)।” - ↑ “व्यधाद्विनापि सामग्रीं तत्र शक्तिं प्रकाशयन्।
पञ्च गौड़ाधिपाञ्जित्वा श्वशुरं तदधीश्वरम्॥ (४।४६५)॥” - ↑ শ্রীযুত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব মহাশয় “ব্রাহ্মণ-কাণ্ড” নামক গ্রন্থের প্রথমাংশে কহ্লণোক্ত “জয়ন্ত” এবং কুলপঞ্জিকা-সমূহে উল্লিখিত পঞ্চব্রাহ্মণ-আনয়নকারী “আদিশূর”কে অভিন্ন বলিয়া প্রতিপাদন করিতে যত্ন করিয়াছেন। তাঁহার প্রথম যুক্তি—“ধর্ম্মপালের পূর্ব্বে এখানে জয়ন্ত ব্যতীত আর কোনও হিন্দু রাজাকে ঐরূপ উচ্চ সম্মানে অলঙ্কৃত দেখি না। ইত্যাদি কারণে সহজেই বোধ হইতেছে, গৌড়াধিপ জয়ন্ত জামাতা কর্ত্তৃক পঞ্চগৌড়ের অধীশ্বর হইলে, ‘আদিশূর’ উপাধি গ্রহণ করেন (১০১ পৃঃ)।” কুলপঞ্জিকার আদিশূর ভিন্ন “পঞ্চগৌড়াধিপ” উপাধিধারী বাঙ্গালার আর কোন স্বাধীন হিন্দু রাজার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। শিলালিপি, তাম্রশাসন, এবং তৎকালীন সংস্কৃত গ্রন্থে দেখা যায়,—বাঙ্গালার স্বাধীন হিন্দুনৃপতিগণ “গৌড়াধিপ” বা “গৌড়েশ্বর” উপাধি লইয়াই তৃপ্ত ছিলেন। আর কহ্লণই বা জয়ন্তকে “পঞ্চগৌড়াধিপ” বলিলেন কোথায়? কহ্লণ বহুবচনান্ত “পঞ্চগৌড়াধিপান্” [গৌড়ের পাঁচ জন নৃপতির] উল্লেখ করিয়াছেন; একবচনান্ত “পঞ্চগৌড়াধিপম্” লিখিয়া যান নাই।
১৮