পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৫৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
দেবপাল।

ছিলেন। দেবপালের আদেশানুসারে, তদীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা জয়পাল, উৎকলে এবং কামরূপে গৌড়েশ্বরের আধিপত্য বিস্তৃত করিয়াছিলেন। নারায়ণপালের [ভাগলপুরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—জয়পাল ভ্রাতা দেবপালের আজ্ঞায় দিগ্বিজয়ার্থ বহির্গত হইলে, উৎকলপতি দূর হইতে নাম শুনিয়াই, ভয়বিহ্বলচিত্তে স্বীয় রাজধানী ত্যাগ করিয়াছিলেন; এবং বন্ধুপরিবেষ্টিত প্রাগজ্যোতিষপতি, তাঁহার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া, যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া, শান্তিলাভ করিয়াছিলেন।”[১] ভগদত্তবংশীয় প্রলম্বের প্রপৌত্র জয়মাল-বীরবাহু সম্ভবত এই সময়ে প্রাগ্‌জ্যোতিষের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাগ্‌জ্যোতিষপতি পরাক্রান্ত গৌড়াধিপের নিকট ন্যূনতা স্বীকার করিয়া, মৈত্রী স্থাপন করিতে বাধ্য হইয়া থাকিবেন। কিন্তু যিনি জয়পালের নাম শুনিয়াই রাজধানী ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছিলেন, সেই উৎকলপতি যে কে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। খৃষ্টীয় নবম, দশম, এবং একাদশ শতাব্দের, অর্থাৎ কলিঙ্গের গঙ্গবংশীয় রাজা অনন্তবর্ম্মা-চোড়গঙ্গ (১০৭৮—১১৪২ খৃঃ অঃ) কর্ত্তৃক উড়িষ্যাবিজয়ের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত, উড়িষ্যার ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। কলিঙ্গের সঙ্গে উড়িষ্যা সপ্তম শতাব্দে যেমন গৌড়াধিপ শশাঙ্কের এবং অষ্টম শতাব্দে গৌড়াধিপ হর্ষের পদানত হইয়াছিল, জয়পাল কর্ত্তৃক উড়িষ্যা-আক্রমণের কাল হইতে, উৎকলপতিগণও সম্ভবত সেইরূপ পাল-রাজগণের পদানত থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 গৌড়াধিপ দেবপালের সেনা-নায়কের পক্ষে প্রাগ্‌জ্যোতিষপতিকে বা উৎকলপতিকে পরাভূত করা খুব সহজ হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু পিতার বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ধার সাধনে প্রয়াসী হইয়া, দেবপালকে ভারতের প্রধান প্রধান নরপালগণের সহিত যে বিরোধে লিপ্ত হইতে হইয়াছিল, তাহাতেই তাঁহার শক্তির প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। ধর্ম্মপালের মন্ত্রী [গর্গের পুত্র] দর্ভপাণি দেবপালের প্রথম মন্ত্রী ছিলেন। দর্ভপাণির প্রপৌত্র গুরবমিশ্র-প্রতিষ্ঠিত হরগৌরীর (বাদলের) স্তম্ভে দর্ভপাণি-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—“তাঁহার নীতিকৌশলে শ্রীদেবপালনৃপ হস্তীর মদজলসিক্ত-শিলাসংহতি-পূর্ণ নর্ম্মদার জনক বিন্ধ্যপর্ব্বত হইতে আরম্ভ করিয়া,  মহেশ-

  1. “রামচরিতে”র ভূমিকায় মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই শ্লোকের মর্ম্মস্বরূপ লিখিয়াছেন, “Jayapāla was a warrior and led several expeditions to Orissa and Kamarupa.” কিন্তু ঘনরাম প্রণীত শ্রীধর্ম্মমঙ্গল অবলম্বন করিয়া লিখিয়াছেন, “Lāusena is said to have conquered Kāmarupa and Kalinga countries for Devapala.” (p. 8) ঘনরামের “শ্রীধর্ম্মমঙ্গল” অপেক্ষাকৃত আধুনিক গ্রন্থ। “শ্রীধর্ম্মমঙ্গলে” “ধর্ম্মপাল নামে ছিল গৌড়ের ঠাকুর” সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা তাম্রশাসন-লব্ধ প্রমাণের বিরোধী। দেবপালের তাম্রশাসনমতে ধর্ম্মপালের উত্তরাধিকারীর জননীর নাম রণ্ণাদেবী, ঘনরামের মতে বল্লভা। দেবপাল ব্যতীত খালিমপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে ধর্ম্মপালের ত্রিভুবনপাল নামক আর এক পুত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু ঘনরামের ধর্ম্মপাল, “অপুত্রক মহারাজা অখিলে প্রকাশ”; পরে সমুদ্রের ঔরসে নির্ব্বাসিতা বল্লভার গর্ভে এক পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল। ঘনরাম কোথাও বল্লভার এই পুত্রের নাম করেন নাই, তাঁহাকে সুধু “গৌড়েশ্বর” বলিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। সুতরাং সুধু ঘনরামের উপরে নির্ভর করিয়া, জয়পালের কামরূপ এবং উৎকল আক্রমণ “expeditions” বলিয়া উড়াইয়া দিয়া, ত্রেতার হনুমান যাহার নিকট আনাগোনা করিতেন, সেই লাউসেনকে কামরূপ এৰং কলিঙ্গ-বিজয়ী বলিয়া স্বীকার করা কঠিন।

২৯