পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গৌড়রাজমালা।

নহে; এবং রামপালের মৃত্যুর পর, হয়ত চোড়-গঙ্গ প্রবলতর হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী যে সত্যের অপলাপ করেন নাই, কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপি এবং বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন তাহার সাক্ষ্যদান করিতেছে। সুতরাং তাঁহার বর্ণিত রামপালের কলিঙ্গ-জয়-কাহিনী অমূলক বলিয়া উপেক্ষিত হইতে পারে না। রাঢ়ও অবশ্য রামপাল কর্ণাট-রাজের কবল হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন। দেবপাড়ার শিলালিপি-অনুসারে, সামন্তসেন যে সকল কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তগণকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন, তাহারা গৌড়াধিপেরই সেনা। সামন্তসেন এই সকল “দুর্বৃত্তগণকে” বিনাশ করিয়াও, রাঢ়ে কর্ণাট-রাজের আধিপত্য অটুট রাখিতে না পারিয়া হয়ত শেষ বয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহানল নির্ব্বাণ করিয়া, এবং কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়া, রামপাল যে গৌড়রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, সেই অভিনব গৌড়রাষ্ট্রের সহিত রামপালের পূর্ব্বপুরুষগণের শাসিত গৌড়রাষ্ট্রের অনেক প্রভেদ ছিল। প্রজাসাধারণের নির্ব্বাচিত গৌড়াধিপ গোপালের গৌড়রাষ্ট্র, প্রজার প্রীতির এবং প্রজাশক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হতভাগ্য দ্বিতীয় মহীপালের “অনীতিকারম্ভের” ফলে, এবং দিব্বোক-নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহানলে, সেই ভিত্তি ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছিল। রামপালের পক্ষে, গৌড়রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরায় একত্রিত করিয়া, উহার পুনর্গঠন সম্ভব হইলেও, সেই দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা,—সেই ভগ্ন অট্টালিকার বহিরঙ্গের সংস্কার সম্ভব হইলেও,—উহার নষ্টভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, অসম্ভব হইয়াছিল। সুতরাং রামপালের মৃত্যুর পরই, আবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে, বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। কিন্তু রামপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র “গৌড়েশ্বর” কুমারপালের, এবং তাঁহার প্রধান-সচিব এবং সেনাপতি, বৈদ্যদেবের বাহুবলে, গৌড়রাষ্ট্রের পতন আরও কিছু কালের জন্য স্থগিত রহিল। বৈদ্যদেবের [কমৌলিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে বৈদ্যদেব কর্ত্তৃক [অনুত্তর বঙ্গে) দক্ষিণবঙ্গে, নৌ-যুদ্ধে জয়লাভ-প্রসঙ্গে, পুনরায় বিদ্রোহ সূচিত হইয়াছে (১১ শ্লোক)। এই সময়ে কামরূপের সামন্ত-নরপতিও বিদ্রোহাচরণ করিয়াছিলেন। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—

 “পূর্ব্বদিগ্বিভাগে বহুমান-প্রাপ্ত তিম্‌গ্যদেব-নৃপতির বিদ্রোহ-বিকার শ্রবণ করিয়া, গৌড়েশ্বর তাঁহার রাজ্যে এইরূপ [গুণগ্রাম-সমন্বিত] বিপুল কীর্ত্তিসম্পন্ন বৈদ্যদেবকে নরেশ্বর-পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সাক্ষাৎ মার্ত্তণ্ড-বিক্রম বিজয়শীল সেই বৈদ্যদেব [আপন] তেজস্বী প্রভুর আজ্ঞাকে মাল্যদামের ন্যায় মস্তকে ধারণ করিয়া, কতিপয় দিবসের দ্রুত-রণযাত্রার [অবসানে] নিজ ভুজবলে সেই অবনিপতিকে যুদ্ধে পরাভূত করিবার পর, [তদীয় রাজ্যে] মহীপতি হইয়াছিলেন (১৩-১৪ শ্লোক)।”

 কুমারপালের মৃত্যুর পর, তদীয় পুত্র [তৃতীয়] গোপাল গৌড়সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। মদনপালের তাম্রশাসন (১৭ শ্লোক) পাঠে অনুমান হয়,—তৃতীয় গোপাল যখন রাজ্যভার প্রাপ্ত হন, তখনও তিনি শৈশবের সীমা অতিক্রম করেন নাই। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন—

৫২