এ কথার মীমাংসার যত্ন করা কর্ত্তব্য। সুতরাং, প্রক্রমভঙ্গ হইলেও, এখানে সেই প্রশ্নের বিচারের পর, বর্ম্ম-বংশের ইতিহাস আলোচিত হইবে।
কুলপঞ্জিকা বা ঐ শ্রেণীর গ্রন্থ ভিন্ন, আর কোথায়ও আদিশূরের পরিচয় পাওয়া যায় না। এখন সকল কুলপঞ্জিকা দেখা যায়, তাহা আদিশূরের আনুমানিক আবির্ভাব-কালের অনেক পরে রচিত। পরবর্ত্তী কালের রচনা হইতে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করিতে হইলে, বিশেষ সাবধানতা আবশ্যক। যে পরবর্ত্তী কালের গ্রন্থে তুল্যকালীন গ্রন্থোক্ত প্রমাণ উদ্ধৃত থাকে, তাহাই কেবল ইতিহাসের উপাদানের ভাণ্ডাররূপে গৃহীত হইতে পারে। কুলগ্রন্থনিচয়ে উল্লিখিত আদিশূর রাজার বিবরণ যে সেরূপ প্রমাণ অবলম্বনে সঙ্কলিত, তাহা এযাবৎ কেহই প্রতিপাদন করিতে পারেন নাই। কারণ, আদিশূরের সময়ের কোন চিহ্নই এখনও পাওয়া যায় নাই। অনেকে বলিতে পারেন, কুলপঞ্জিকার আদিশূর রাজার বিবরণ প্রত্যক্ষ প্রমাণমূলক না হইলেও, জনশ্রুতিমূলক; এবং জনশ্রুতির যদি ইতিহাসে স্থানলাভ করিবার অধিকার থাকে, তবে আদিশূর রাজার বিবরণ ইতিহাসে স্থান পাইবে না কেন? জনশ্রুতিমাত্রই যে প্রামাণ্য এবং ঐতিহাসিকের নিকট আদরণীয়, এমন নহে। যে জনশ্রুতি প্রবল এবং প্রত্যক্ষপ্রমাণের অবিরোধী, তাহাই ঐতিহাসিকের বিবেচ্য; এবং যে প্রবল জনশ্রুতি প্রত্যক্ষ প্রমাণের অনুকূল, তাহাই ইতিহাসে স্থান লাভের যোগ্য।
এখন আদিশূর সম্বন্ধীয় জনশ্রুতির পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক্, উহার ঐতিহাসিকতা কত দূর। রাঢ়ীয় কুলজ্ঞগণের মধ্যে প্রচলিত আদিশূর সম্বন্ধীয় জনশ্রুতি নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে বিনিবদ্ধ আছে—
“आसीत् पुरा महाराज आदिशूर प्रतापवान्।
आनीतवान् द्विजान् पञ्च पञ्चगोत्र-समुद्भवान्॥”[১]
এখানে পাওয়া গেল,—আদিশূর ছিলেন (আসীৎ)। বারেন্দ্র কুলজ্ঞগণের গ্রন্থে আরও কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁহারা আদিশূরের এবং বল্লালসেনের সম্বন্ধ নিরূপণ করিয়াছেন। যথা—
- ↑ রাজসাহীর রাণী হেমন্তকুমারী-সংস্কৃতকলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক বিক্রমপুর-নিবাসী পণ্ডিতবর শ্রীযুত বামনদাস বিদ্যারত্ন মহাশয় লেখককে যে পাতড়া দিয়াছেন, তাহার আরম্ভে এই শ্লোকটি আছে। তৎপরে আর ১৩টি শ্লোকে পঞ্চব্রাহ্মণের আগমনবৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে, এবং উপসংহারে আছে—“ইতি আদিশূর-ব্যাখ্যানং সমাপ্তং।” বিদ্যারত্ন মহাশয় বলেন, এই শ্লোক কয়টি “কুলরমার” সূচনায় দৃষ্ট হয়। আমার পরীক্ষিত রাঢ়ীয় কুলগ্রন্থ মধ্যে ধ্রুবানন্দমিশ্রের “মহাবংশাবলী”-গ্রন্থে কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চব্রাহ্মণ আগমনের কোন উল্লেখ নাই। ধ্রুবানন্দ “নত্বা তাং কুলদেবতাং” ইত্যাদি শ্লোকে মঙ্গলাচরণ করিয়া আরম্ভ করিয়াছেন—
“आयितो बहुरूपाख्यः शिरो गोवर्द्धनः सुधीः।
गां शिशो मकरन्दश्च जाल्वनाख्यः समा इमे॥”মহেশের “নির্দ্দোষ কুলপঞ্জিকায়”—
“क्षितीशो तिथिमेधा[च] वीतरागः सुधानिधिः।
सौभरिः पञ्चधर्म्मात्मा आगता गौड़-मण्डले॥”এই পর্য্যন্ত উল্লিখিত হইয়াছে, আদিশূরের নাম নাই।
৫৭