পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বাঙ্গালীর ইতিহাসের গৌরব-যুগ।

প্রধান কথা,—এই গৌড়ীয়-সাম্রাজ্যের উথান-পতনের কথা। কারণ, ইহার সকল কথাই বাঙ্গালীর কথা।

 একটি কারণে, এ সকল কথা বাঙ্গালীর নিকট যথাযোগ্য সমাদর লাভ করিতে পারে নাই। পাল-নরপালগণের জন্মভূমি কোথায় ছিল, তাঁহারা কিরূপে গৌড়ীয় সাম্রাজ্যে অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, তাহার আলোচনা করিতে গিয়া, অনেকেই সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন,—তাঁহারা মগধবাসী, মগধের অধিপতি ছিলেন; এবং ক্রমে বঙ্গভূমিতে রাজ্য বিস্তৃত করিয়া, “গৌড়েশ্বর” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন;—বাঙ্গালীরা তাঁহাদিগের পদানত হইয়াই বাস করিত। ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনে পাটলিপুত্রে, দেবপালদেবের তাম্রশাসনে মুদ্গগিরিতে [মুঙ্গেরে], এবং নারায়ণপালদেবের তাম্রশাসনেও মুদ্গগিরিতে “জয়স্কন্ধাবার” সংস্থাপিত থাকিবার প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়া, [অনেকের ন্যায়] আমি নিজেও সিদ্ধান্ত করিয়াছিলাম,—পঞ্চ-পাল-নরপাল বঙ্গভূমিতে বাস করিতেন না। বরেন্দ্রমণ্ডলে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত হইবামাত্র, সে সিদ্ধান্ত পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। বরেন্দ্রমণ্ডলে সংস্থাপিত গরুড়-স্তম্ভের দ্বিতীয় শ্লোকে, ধর্ম্ম[পাল] প্রথমে পূর্ব্বদিকের অধিপতি থাকিয়া, পরে [মন্ত্রিবর গর্গের মন্ত্রণা-কৌশলে] “অখিল দিকের” অধিপতি হইবার উল্লেখ আছে। তারানাথের গ্রন্থেও, প্রথমে গৌড়, পরে মগধ, বিজিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। “রামচরিত”-কাব্যে বরেন্দ্রভূমিই পাল-নরপালগণের “জনকভূমি” বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। সুতরাং, পাল-নরপালগণ যে বাঙ্গালী ছিলেন, তাহাতে আর সংশয়-প্রকাশের উপায় নাই।

 পাল-নরপালগণ যদি বাঙ্গালী হইবেন, তবে তাঁহাদিগের রাজধানী কোথায় বিলুপ্ত হইয়া গেল? বাঙ্গালা দেশের কোন্ নিভৃত নিকেতনে বাঙ্গালীর নির্ব্বাচিত বাঙ্গালী নরপাল [গোপালদেব] রাজমুকুট মস্তকে ধারণ করিয়াছিলেন? কোন্ ভূমিখণ্ডে বাঙ্গালী প্রজাপুঞ্জের হৃদয় এরূপ অচিঞ্চিতপূর্ব্ব প্রজাশক্তি-বিকাশের প্রশংসনীয় গৌরবে স্ফীত ও স্পন্দিত হইয়া উঠিয়াছিল? কেহ কেহ [গৃহে বসিয়াই] ইহার মীমাংসা করিতে গিয়া, মীমাংসা-সাধনের অন্য উপায় না দেখিয়া, অনুমান-বলে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন,—পাল নরপালগণের রাজধানী এক স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল না; তাঁহারা জয়স্কন্ধাবারেই বাস করিতে ভাল বাসিতেন; যেখানে যখন জয়স্কন্ধাবার সংস্থাপিত হইত, সেখানেই একটি তৎকালোচিত রাজনগর গঠিত হইয়া উঠিত।

 রাজার পক্ষে এরূপ “যাযাবর-বৃত্তি” কখন কখন আনন্দপ্রদ হইবার সম্ভাবনা থাকিলেও, রাজ্যের পক্ষে এরূপ ব্যবস্থা নিতান্ত অসম্ভব বলিয়াই প্রতিভাত হইবে। যে রাজবংশ আর্য্যাবর্ত্তব্যাপী বিপুল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হইয়াছিল, কোনও স্থানেই তাহার স্থায়ী রাজধানী বর্ত্তমান ছিল না,—এরূপ অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করিতে সাহসী না হইয়া,—অনুসন্ধান-সমিতি, বরেন্দ্র-মণ্ডলে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া, বিবিধ রাজনগরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান লাভ করিয়াছেন। “বিবরণ-মালায়” তাহার বিবরণ এবং প্রমাণাবলী সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 এ পর্য্যন্ত পাল-রাজবংশের দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, নবম, একাদশ, এবং সপ্তদশ নরপালের

 
৷৴৹