গৌড়রাজমালা।
বিরচিত বিজয়সেনের প্রশস্তি-সম্বলিত শিলা-ফলক বরেন্দ্রের অন্তর্গত দেবপাড়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল।
বিজয়সেনের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী [বল্লালসেন] পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, সমগ্র গৌড়রাষ্ট্র করায়ত্ত করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন। বিজয়সেন পালবংশজ “গৌড়েন্দ্র”কে আক্রমণ করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছিলেন। বল্লালসেন, স্বীয় অভীষ্ট সাধনের জন্য, পাল-রাজবংশ উন্মূলিত করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। ১১৬১ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দপালদেব সম্ভবত বল্লালসেন কর্ত্তৃকই রাজ্যভ্রষ্ট হইয়াছিলেন। বর্ম্মরাজকে পদচ্যুত বা পদানত করিয়া, বল্লালসেন বঙ্গে এবং রাঢ়ে স্বীয় আধিপত্য বিস্তৃত করিয়াছিলেন। রাজত্বের “সং ১১ বৈশাখদিনে ১৬” সম্পাদিত, [কাটোয়ার নিকটে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে তাঁহার বঙ্গ এবং রাঢ় অধিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। এই তাম্রশাসন “শ্রীবিক্রমপুর-সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবারে” সম্পাদিত হইয়াছিল, এবং এতদ্বারা “শ্রীবর্দ্ধমান-ভুক্ত্যন্তঃপাতী উত্তররাঢ়া-মণ্ডলের” ভূমি দান করা হইয়াছিল। বল্লালসেন সস্তবত কলিঙ্গ-রাজ্যও আক্রমণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—লক্ষ্মণসেন “কলিঙ্গরমণীগণের সহিত কৌমার-কেলি করিয়াছিলেন।” ইহার অর্থ এই,–লক্ষ্মণসেন যখন যুবরাজ, তখন পিতার সহিত অথবা পিতার আদেশানুসারে, কলিঙ্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন।
১১৫৯ খৃষ্টাব্দে বল্লালসেনের রাজ্যলাভ ধরিলে, “সং ১১” [কাটোয়ার তাম্রশাসনের সম্পাদনকাল] ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে নির্দ্ধারিত হইতে পারে। এই বৎসর বল্লালসেন “দানসাগর” সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, এবং ইহার পূর্ব্ব বৎসর, “অদ্ভুতসাগরের” সঙ্কলন আরম্ভ করিয়া, তাহা সমাপ্ত না হইতেই, স্বৰ্গারোহন করিয়াছিলেন। ইহাতে অনুমান হয়,—“দানসাগর” সঙ্কলিত হওয়ার [১১৬৯ খৃষ্টাব্দের] পরে, বল্লালসেন বড় অধিক দিন জীবিত ছিলেন না। “দানসাগরের” মঙ্গলাচরণে তিনি আপনাকে “গৌড়েশ্বর” বলিয়াছেন। পরবর্ত্তী-কালের গৌড়রাষ্ট্রের ইতিহাস আলোচনা করিলে প্রতীয়মান হয়,—বল্লালসেন গৌড়রাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দিহীন করিতে সমর্থ হইলেও, দ্বাদশ কি ত্রয়োদশ বর্ষস্থায়ী রাজত্বকালে,—বিস্তীর্ণ গৌড়-মণ্ডলের বিভিন্ন অংশ সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করিবার—গৌড়রাষ্ট্র পুনরায় সুগঠিত এবং এককেন্দ্রীভূত করিবার—অবসর পাইয়ছিলেন না।
বল্লালসেন যে গৌড়রাষ্ট্র-পুনর্গঠনব্রত অসমাপ্ত অবস্থায় রাখিয়া, পরলোক গমন করিয়াছিলেন; তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণসেন তাহা সমাপ্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। লক্ষ্মণসেনের এই অক্ষমতাই গৌড়ের সর্ব্বনাশের কারণ। লক্ষ্মণসেন পিতৃপিতামহের আরব্ধ কার্য্য সুসম্পন্ন করিতে যত্নের ত্রুটি করেন নাই; কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র কিছুই সে মহদনুষ্ঠানের উপযোগী ছিল না। লক্ষ্মণসেনের, ধর্ম্মপাল-মহীপাল-রামপালের তুল্য প্রতিভা ছিল না। প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচিত [বহুকাল গৌড়সিংহাসনের অধিকারী] গোপালের বংশধরগণকে গৌড়জন যেরূপ ভক্তি-নেত্রে দেখিতেন, বিদেশাগত পালরাজকুল-উন্মূলনকারী বিজয়সেনের এবং বল্লালসেনের উত্তরাধিকারী লক্ষ্মণসেন সেরূপ ভক্তি লাভ করিতে পারিয়াছিলেন না। সেকাল
৬৬