আর একালে প্রভেদও অনেক ছিল। বরেন্দ্রের বিদ্রোহে গৌড়ের প্রজাশক্তি এবং রাজশক্তি এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ উপস্থিত হইয়াছিল, কর্ণাটাগত সেনবংশের অভ্যুদয়ে, তাহা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল; এবং “মাৎস্য-ন্যায়” নিবারণের, অথবা “অনীতিকারম্ভের” প্রতীকারের অধিকার বিস্মৃত হইয়া, গৌড়জন কালস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ারের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্ব্বনাশের মূল বা সর্ব্বনাশের ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে না; বিজয়সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্ব্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে।
গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনও অবশ্যই কলিঙ্গ-পতি এবং কামরূপ-পতিকে বশীভূত রাখিতে যত্ন করিয়াছিলেন; এবং ১১৪২ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দচন্দ্রর আক্রমণ-মূলে কান্যকুব্জেশ্বরের মগধের উপর যে দাবী জন্মিয়াছিল, তাহার নিকাশ করিবার জন্য, কান্যকুব্জেশ্বরের সহিতও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। মাধাইনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেন “বিক্রম-বশীকৃত-কামরূপঃ” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেম। লক্ষ্মণসেনের সময়, গৌড়-সেনা যে কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল, তৎসম্পর্কে অপর পক্ষও সাক্ষ্যদান করিতেছে। আসামে প্রাপ্ত কুমার বল্লভদেবের ১১০৭ শক-সম্বতের [১১৮৪-৮৫ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন[১] হইতে জানা যায়, বল্লভদেবের পিতামহ রায়ারিদেব-ত্রৈলোক্যসিংহের সময়, গৌড়সেনা কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল। এই শাসনে উক্ত হইয়াছে—“ভাস্কর-বংশীয় নৃপ-শিরোমণি রায়ারিদেব বঙ্গের মহাকায় করি-নিচয়ের উপস্থিতি-নিবন্ধন-ভয়াবহ সমরোৎসবে শত্রুগণকে অস্ত্রচালনা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন (৫ শ্লোক)।” রায়ারিদেব গৌড়-সেনা পরাজিত করিয়াছিলেন, এ কথা এখানে স্পষ্ট বলা হয় নাই। সুতরাং মাধাইনগর-তাম্রশাসনে উক্ত-“বিক্রমবশীকৃতকামরূপঃ”—নিরর্থক না হইতেও পারে।
লক্ষ্মণসেনের এবং বিশ্বরূপসেনের প্রশস্তিকার, লক্ষ্মণসেন কর্ত্তৃক কাশি-রাজের (কান্যকুব্জ-রাজের) এবং কলিঙ্গ-রাজেরও পরাজয়ের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। মাধাইনগরের তাম্রশাসনে ক্ষোদিত রহিয়াছে,—“তিনি সমরক্ষেত্রে কাশি-রাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন।” বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—দক্ষিণসাগরের তীরে, পুরুষোত্তম-ক্ষেত্রে—অসি, বরণা, এবং গঙ্গাসঙ্গমে বিশ্বেশ্বরের কাশীধামে—ত্রিবেণী-সঙ্গমে প্রয়াগধামে—লক্ষ্মণসেন উচ্চ যজ্ঞ-যূপের সহিত সমর-জয়স্তম্ভ-মালা স্থাপিত করিয়াছিলেন (১২ শ্লোক)। লক্ষ্মণসেন যখন গৌড়াধিপ, তখন কান্যকুব্জের সিংহাসনে গাহড়-বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্র, এবং কলিঙ্গের সিংহাসনে দ্বিতীয় রাজরাজ, এবং তৎপরে দ্বিতীয় অনঙ্গভীম, সমাসীন ছিলেন। ইঁহারা কেহই গৌড়াধিপের তুলা পরাক্রমশালী ছিলেন না। সুতরাং ইঁহা-
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. V. pp. 184.
“येनापास्त-समस्त-शस्त्र-समयः संग्रामभूमौ रिपु
श्चक्रे वङ्ग-करीन्द्र-सङ्ग-विषमे साटोप-युद्धोत्सवे।
येनात्यर्थमयं स्वयं सफलित स्त्रैलोक्यसिंहो विधिः
सोभूद्भास्कर-वंश-राजतिलको रायारिदेवो नृपः॥”
৬৭