গৌড়রাজমালা।
দিগের সহিত যুদ্ধে গৌড়াধিপের জয়লাভ অসম্ভব নহে। কিন্তু লক্ষ্মণসেন গৌড়-রাষ্ট্রের বহিঃশত্রু দমনে সমর্থ হইয়া থাকিলেও, প্রজাপুঞ্জের সহযোগিতার অভাবে, আভ্যন্তরীণ ঐক্যসাধনে, এবং বিভিন্ন অংশের রক্ষার সুব্যবস্থা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। সেই জন্যই মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার অবাধে মগধ এবং বরেন্দ্র অধিকার করিতে পারিয়াছিলেন।
তুরূষ্কগণের গৌড়বিজয়-রহস্য বুঝিতে হইলে, তুরূষ্ক-চরিত্র এবং তাহাদিগের উত্তরাপথের অপরাপর অংশের বিজয়-বৃত্তান্ত সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন। আরবগণ উত্তরাপথের সিংহদ্বারোদ্ঘাটনে সমর্থ হইয়াছিলেন না। যাঁহারা সেই দুরূহ কার্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন, তাঁহারা [সবুক্তিগিন, মামুদ, এবং তাঁহাদের অনুচরগণ] তুরূষ্ক-জাতীয়। মধ্য-এসিয়ার মরুময় মালভূমি তুরূষ্কগণের আদি-নিবাস; নিয়ত পালিত পশুপাল লইয়া, গোচারণক্ষেত্রের অনুসন্ধান করাই ইহাদিগের বৃত্তি ছিল। আদিবাস-ভূমির জলবায়ু এবং চির-অভ্যাস মধ্য-এসিয়ার অধিবাসিগণকে কঠোরক্ষম, চঞ্চল এবং অগ্রগমনশীল করিয়া তুলিয়াছিল। চিরচাঞ্চল্য এবং অগ্রগমনশীলতা মধ্য-এসিয়ার অধিবাসিগণের জাতীয় চরিত্রের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। এই জাতীয় চরিত্রের বলে বলীয়ান ইউচিগণ, আদি-নিবাসস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, [খৃষ্ট-পূর্ব্ব প্রথম শতাব্দে] কুষাণসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠত করিয়াছিলেন; হূণগণ খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দে পূর্ব্ব-ইউরোপ এবং দক্ষিণ-এসিয়া ধ্বস্তবিধ্বস্ত করিয়াছিলেন; খৃষ্টীয় নবম হইতে পঞ্চদশ শতাব্দ পর্য্যন্ত তুরূষ্কগণ এবং [তাঁহাদের জ্ঞাতি] মোগলগণ, অবিরলধারে দলে দলে আসিয়া, ক্রমে আরব-সাম্রাজ্য, রোম-সাম্রাজ্য, চীন-সাম্রাজ্য এবং আরও অনেক প্রাচীন রাজ্য এবং প্রাচীন সভ্যতা বিনষ্ট করিয়াছিলেন। কি এসিয়ায়, কি ইউরোপে, সুসভ্য স্থির-নিবাস কৃষিজীবি জনগণ কখনও মরুভূমির কঠোরকর্ম্মী চঞ্চল সন্তানগণের আক্রমণবেগের গতিরোধ করিতে পারে নাই। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দের সূচনা হইতে, যাহাদিগের আক্রমণ-প্রবাহ উত্তরাপথে প্রধাবিত হইয়া, ক্রমে হিন্দু-স্বাধীনতা বিলুপ্ত এবং হিন্দু-সভ্যতা ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তাহারা তুরূষ্ক-জাতীয়। মুসলমানধর্ম্মাবলম্বী হইলেও, জাতীয় চরিত্রের প্রেরণাই তাহাদিগকে ভারত-আক্রমণে ব্রতী করিয়াছিল; এবং আদি-নিবাসভূমির কঠোর শিক্ষা তাহাদিগকে শস্য-শ্যামলা ভারতমাতার আদরে লালিত পালিত সন্তানগণের পক্ষে দুর্জ্জেয় করিয়া তুলিয়াছিল। উত্তরাপথের একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দের রাজনীতিক অবস্থা—ঐক্যবিধানক্ষম সার্ব্বভৌম-নৃপতির অভাব, এবং অন্তর্দ্রোহ, আক্রমণকারিগণের পথের প্রকৃত বাধা অন্তর্হিত করিয়া রাখিয়াছিল।
গজনীর সুলতান মামুদের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই, সেল্জুকিয়া-তুরূষ্কগণ, মধ্য-এসিয়া হইতে বিনির্গত হইয়া, মামুদের সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশ কাড়িয়া লইয়া গজনী-রাজ্যের তুরূষ্কগণকে হীনবল এবং তুরূষ্ক-প্রবাহের প্রস্রবণ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু তথাপি তাহারা পঞ্জাবের পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইবার চেষ্টা কখনও পরিত্যাগ করেন নাই। সুলতান মসুদের সময়, আহম্মদ নিয়াল্তিগীন্ কর্ত্তৃক বারাণসী-আক্রমণ পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। মসুদের উত্তরাধিকারী
৬৮