লেখমালা।
ভাষা যেরূপ থাকুক না কেন, [মুসলমান-শাসন প্রবর্ত্তিত হইবার পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত] বাঙ্গালা দেশের রাজসভায় এবং বিদ্বৎসমাজে সংস্কৃত ভাষাই রচনাকার্য্যে সমাদর লাভ করিত। তৎকালে এদেশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট সংস্কৃত ভাষা সুপরিচিত না থাকিলে, এরূপ হইতে পারিত না। রচনা-পারিপাট্যের মধ্যে যেরূপ ভাষাজ্ঞান বিকশিত হইয়া রহিয়াছে, সংস্কৃত-সাহিত্যের অনুশীলন প্রবল না থাকিলে, তাহা সেরূপ বিকশিত হইতে পারিত না। ধর্ম্মসম্প্রদায়গুলির গ্রন্থনিহিত উপদেশ সংস্কৃত ভাষাতেই লিখিত, অধীত এবং অধ্যাপিত হইত। সুতরাং সংস্কৃত শিক্ষাই যে তৎকালে এদেশে উচ্চশিক্ষা বলিয়া সুপরিচিত ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। কোন্ শ্রেণীর গ্রন্থ পাঠ করিয়া তৎকালের জনসমাজ উচ্চশিক্ষা লাভ করিত, প্রাচীন লিপিতে প্রসঙ্গক্রমে তাহারও কিছু কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। কেবল তাহাই নহে,—প্রসঙ্গক্রমে অনেক বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের, পৌরাণিক আখ্যান-বস্তুর, ঐতিহাসিক জনশ্রুতির এবং প্রচলিত লোকব্যবহারেরও পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে দেশের লিখিত ইতিহাস বর্ত্তমান নাই, সে দেশের পক্ষে প্রাচীন লিপি হইতে এই সকল বিবরণ সঙ্কলনের প্রয়োজন কত অধিক, তাহা সহজেই অনুভূত হইতে পারে।
সকল দেশেই দুইটি শক্তি জনসাধারণের উন্নতির এবং অবনতির গতিনির্দ্দেশ করিয়া থাকে। তাহা রাজশক্তি এবং প্রজাশক্তি নামে সুপরিচিত। বাঙ্গালাদেশে এই উভয় শক্তির মধ্যে পুরাকালে কিরূপ সম্বন্ধ বর্ত্তমান ছিল, কি কারণে এই উভয় শক্তির সমন্বয় বা সংঘর্ষ সংঘটিত হইত, কোন্ প্রণালীতে শাসনসংরক্ষণ-কার্য্য পরিচালিত হইত, তাহার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এই সকল প্রাচীন লিপিতেই পুনঃ পুনঃ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা আছে।
কাহারও প্রার্থনাক্রমেই হউক, অথবা স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়াই হউক, রাজা কাহাকেও ভূমিদান করিতে প্রবৃত্ত হইলে, প্রকৃতিপুঞ্জকে সম্বোধন করিয়া “मतमस्तु भवताम्” বলিয়া তাহাদের সম্মতি গ্রহণ করিতেন। ইহাকে অন্তঃসারশূন্য সৌজন্য-বিজ্ঞাপক শিষ্টাচারমাত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে সাহস হয় না। কোন্ গ্রামে কাহারা বাস করিবে, কাহারা ভূমিকর্ষণ করিবে, কাহারা উৎপন্ন শস্য উপভোগ করিবে, তাহার সহিত প্রথমে রাজার কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিল বলিয়া বোধ হয় না;—গ্রামের লোকই তাহার একমাত্র নিয়ামক ছিল। ভূমিবিক্রয়ের প্রথা প্রচলিত হইবার পর, অনেকদিন পর্য্যন্ত যাহাকে তাহাকে ভূমি বিক্রয় করিবার উপায় ছিল না;—কাহাকে বিক্রয় করিতে হইবে, তদ্বিষয়ে গ্রামের লোকের অনুমতি গ্রহণ করিতে হইত। কাহাকেও ভূমিদানের পাত্র বলিয়া নির্ব্বাচন করিবার অধিকার রাজার ইচ্ছার উপরে নির্ভর করিলেও, প্রাচীন প্রথার মর্য্যাদারক্ষার্থ, ভূমিদান করিবার সময়ে রাজাকেও প্রজাবর্গের সম্মতি গ্রহণ করিতে হইত;—প্রজাশক্তিকে সর্ব্বতোভাবে অস্বীকার করিবার নিয়ম ছিল না। সে শক্তিকে তুচ্ছ করিবার সম্ভাবনাও বড় অধিক ছিল বলিয়া বোধ হয় না। কারণ, সে শক্তি কখন কখন রাজা নির্ব্বাচন
৬