পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১০১

 সন্দীপ বললেন, এ নিয়ে নিখিলের সঙ্গে আমার অনেক কথা-কাটাকাটি হয়ে গেছে, কিছুতে পেরে উঠলুম না। ও বলে, বক্তৃতা পর্যন্ত চলবে, কিন্তু জবরদস্তি চলবে না।

 আমি একটু অহংকার করে বললুম, আচ্ছা, সে আমি দেখছি।

 আমি জানি, আমার উপর আমার স্বামীর ভালােবাসা কত গভীর। সেদিন আমার বুদ্ধি যদি স্থির থাকত তা হলে আমার পােড়া মুখ নিয়ে এমন দিনে সেই ভালােবাসার উপর দাবি করতে যেতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেত। কিন্তু সন্দীপকে যে দেখাতে হবে আমার শক্তি কত। তাঁর কাছে আমি যে শক্তিরূপিণী। তিনি তাঁর আশ্চর্য ব্যাখ্যার দ্বারা বার বার আমাকে এই কথাই বুঝিয়েছেন যে, পরমাশক্তি এক-একজন বিশেষ মানুষের কাছে এক-একজন বিশেষ মানুষেরই রূপে দেখা দেন। তিনি বলেন, আমরা বৈষ্ণবতত্ত্বের হ্লাদিনীশক্তিকে প্রত্যক্ষ দেখবার জন্যেই এত ব্যাকুল হয়ে বেড়াচ্ছি; যখন কোথাও দেখতে পাই তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার অন্তরের মধ্যে যে ত্রিভঙ্গ বাঁশি বাজাচ্ছেন তার বাঁশির অর্থটা কী। বলতে-বলতে এক-এক দিন তিনি গান ধরতেন—

যখন দেখা দাও নি রাধা তখন বেজেছিল  বাঁশি
এখন চোখে চোখে চেয়ে  সুর যে আমার গেল ভাসি।
তখন নানা তানের ছলে
ডাক ফিরেছে জলে স্থলে,
এখন আমার সকল কাঁদা রাধার রূপে উঠল হাসি।

 এই-সব কেবলই শুনতে শুনতে আমি ভুলে গিয়েছিলুম যে আমি বিমলা। আমি শক্তিতত্ত্ব, আমি রসতত্ত্ব, আমার কোনাে বন্ধন নেই, আমার মধ্যে সমস্তই সম্ভব, আমি যা-কিছুকে স্পর্শ করছি তাকেই নূতন করে সৃষ্টি করছি। নূতন করে সৃষ্টি করছি আমার এই জগৎকে; আমার হৃদয়ের পরশমণি ছোঁওয়াবার আগে শরতের আকাশে এত সােনা ছিল না; আর, মুহূর্তে মুহূর্তে আমি নূতন করছি ঐ বীরকে, ঐ সাধককে, ঐ আমার ভক্তকে— ঐ জ্ঞানে উজ্জ্বল, তেজে উদ্দীপ্ত ভাবের রসে অভিষিক্ত অপূর্ব প্রতিভাকে। আমি যে স্পষ্ট অনুভব করছি, ওর মধ্যে প্রতি ক্ষণে আমি নূতন প্রাণ ঢেলে দিচ্ছি, ও আমার নিজেরই সৃষ্টি। সেদিন অনেক অনুরােধ করে সন্দীপ তাঁর একটি বিশেষ ভক্ত বালক অমূল্যচরণকে আমার কাছে এনেছিলেন। এক দণ্ড পরেই আমি দেখতে পেলুম, তার চোখের তারার মধ্যে একটা নূতন দীপ্তি জ্বলে