পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৪
ঘরে-বাইরে

কোথায় গিয়েছিলি’, সব-ছােটো ছেলেটি তার কোল দখল করে বসলে, আর সেজো মেয়েটি পিঠের উপর পড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলে— তখন কান্নার পর কান্না, কিছুতে তার কান্না থামতে চায় না। বলতে লাগল, মাস্টার-বাবু, এগুলােকে দু-বেলা পেট ভরে খাওয়াব সে শক্তিও নেই, আবার এদের ফেলে রেখে দৌড় মারব সে মুক্তিও নেই, এমন করে বেঁধে মার কেন! আমি কী পাপ করেছিলুম!

 এদিকে যে-ব্যবসাটুকু ধরে কোনােমতে তার দিন চলছিল তার সূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রথম দিনকতক ঐ-যে মাস্টারমশায়ের ওখানে সে বাসা পেলে সেইটেকেই সে টেনে চলতে লাগল; তার নিজের বাড়িতে নড়বার নামও করতে চায় না। শেষকালে মাস্টারমশায় তাকে বললেন, পঞ্চু, তুমি বাড়িতে যাও, নইলে তােমার ঘর-দুয়ারগুলাে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তােমাকে কিছু টাকা ধার দিচ্ছি, তুমি কাপড়ের ব্যবসা করে অল্প অল্প করে শােধ দিয়াে।

 প্রথমটা পঞ্চুর মনে একটু খেদ হল। মনে করলে, দয়াধর্ম বলে একটা জিনিস জগতে নেই। তারপর টাকাটা নেবার বেলায় মাস্টারমশায় যখন হ্যাণ্ডনােট লিখিয়ে নিলেন তখন ভাবলে, শােধ তাে করতে হবে এমন উপকারের মূল্য কী!

 মাস্টারমশায় কাউকে বাইরের দিকে দান করে ভিতরের দিকে ঋণী করতে নিতান্ত নারাজ। তিনি বলেন, মনের ইজ্জত চলে গেলে মানুষের জাত মারা হয়।

 হ্যাণ্ডনােটে টাকা নেওয়ার পর পঞ্চু মাস্টারমশায়কে খুব বড়াে করে প্রণাম করতে আর পারলে না, পায়ের ধুলােটা বাদ পড়ল। মাস্টারমশায় মনে মনে হাসলেন, তিনি প্রণামটা খাটো করতে পারলেই বাঁচেন। তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধা করব, আমাকে শ্রদ্ধা করবে, মানুষের সঙ্গে এই সম্বন্ধই আমার খাটি। ভক্তি আমার পাওনার অতিরিক্ত।

 পঞ্চ কিছু ধুতি-শাড়ি কিছু শীতের কাপড় কিনে আনিয়ে চাষীদের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতে লাগল। নগদ দাম পেত না বটে, তেমনি কিছু বা ধান, কিছু বা পাট, কিছু বা অন্য ফসল যা হাতে হাতে আদায় করে আনত সেটা দামে কাটা যেত না। দু মাসের মধ্যেই সে মাস্টারমশায়ের এক কিস্তি সুদ এবং আসলের কিছু শােধ করে দিলে এবং এই ঋণ শােধের অংশ প্রণামের থেকে কাটান পড়ল। পঞ্চু নিশ্চয় মনে করতে লাগল, মাস্টারমশায়কে সে যে একদিন গুরু বলে ঠাউরেছিল, ভুল করেছিল; লােকটার কাঞ্চনের প্রতি দৃষ্টি আছে।