এই রকমে পঞ্চুর দিন চলে যাচ্ছিল। এমন সময় স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল। আমাদের এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে যে-সব ছেলে কলকাতার স্কুল-কলেজে পড়ত তারা ছুটির সময় বাড়ি ফিরে এল; তাদের অনেকে স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিল। তারা সবাই সন্দীপকে দলপতি করে স্বদেশীপ্রচারে মেতে উঠল। এদের অনেকেই আমার অবৈতনিক স্কুল থেকে এনট্রেন্স পাস করে গেছে, অনেককেই আমি কলকাতায় পড়বার বৃত্তি দিয়েছি। এরা একদিন দল বেঁধে আমার কাছে এসে উপস্থিত। বললে, আমাদের শুকসায়র হাট থেকে বিলিতি সুতাে ব্যাপার প্রভৃতি একেবারে উঠিয়ে দিতে হবে।
আমি বললুম, সে আমি পারব না।
তারা বললে, কেন, আপনার লােকসান হবে?
বুঝলুম, কথাটা আমাকে একটু অপমান করে বলবার জন্যে। আমি বলতে চাচ্ছিলুম, আমার লােকসান নয়, গরিবের লােকসান।
মাস্টারমশায় ছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, হাঁ, ওঁর লােকসান বৈকি, সে লােকসান তাে তােমাদের নয়।
তারা বললে, দেশের জন্যে—
মাস্টারমশায় তাদের কথা চাপা দিয়ে বললেন, দেশ বলতে মাটি তাে নয়, এই-সমস্ত মানুষই তাে। তা, তােমরা কোনােদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? আর, আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কী নুন খাবে আর কী কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ! এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন?
তারা বললে, আমরা নিজেরাও তাে দিশি নুন, দিশি চিনি, দিশি কাপড় ধরেছি।
তিনি বললেন, তােমাদের মনে রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তােমরা যা করছ খুশি হয়ে করছ— তােমাদের পয়সা আছে, তােমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দেশি জিনিস কিনছ— তােমাদের সেই খুশিতে ওরা তাে বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তােমরা যা করাতে চাচ্ছ সেটা কেবল জোরের উপরে। ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাঁচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষনিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনােমতে টিঁকে থাকবার জন্যে। ওদের কাছে দুটো পয়সার দাম কত সে তােমরা কল্পনাও করতে পার না। ওদের সঙ্গে তােমাদের তুলনা কোথায়! জীবনের মহলে বরাবর তােমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে। আর, আজ তােমাদের দায় ওদের কাঁধের উপর চাপাতে চাও? তােমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে