পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১০৭

ব্রত সাঙ্গ হয় তখন দিশি কারুকার্যের নমুনা দেখে তােমরাই সব চেয়ে চেঁচিয়ে হাসবে। আর, কোথাও যদি সেই রঙিন গামছার অর্ডার এবং আদর মেলে সে ইংরেজের কাছে।

 এতদিন ওঁর কাছে আছি, মাস্টারমশায়ের এমনতরাে শান্তিভঙ্গ হতে আমি কোনােদিন দেখি নি। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, কিছুদিন থেকে ওঁর হৃদয়ের মধ্যে একটা বেদনা নিঃশব্দে জমে আসছে— সে কেবল আমাকে ভালােবাসেন বলে। সেই বেদনাতেই ওঁর ধৈর্যের বাঁধ ভিতরে ভিতরে ক্ষয় করে দিয়েছে।

 মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বলে উঠল, আপনারা বয়সে বড়ো, আপনাদের সঙ্গে তর্ক আমরা করব না। তা হলে এক কথায় বলুন— আপনাদের হাট থেকে বিলিতি মাল আপনারা সরাবেন না?

 আমি বললুম, না, সরাব না। কারণ, সে মাল আমার নয়।

 এম. এ. ক্লাসের ছাত্রটি ঈষৎ হেসে বললে, কারণ, তাতে আপনার লােকসান আছে?

 মাস্টারমশায় বললেন, হাঁ, তাতে ওঁর লােকসান আছে। সুতরাং সে উনিই বুঝবেন।

 তখন ছাত্রেরা সকলে উচ্চস্বরে ‘বন্দে মাতরং’ বলে চীৎকার করে বেরিয়ে গেল।

 এর কিছুদিন পরেই মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?

 ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে একশাে টাকা জরিমানা করেছে।

 কেন, ওর অপরাধ কী?

 ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলাে বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনাে করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলাে পুড়িয়ে ফেল্ তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তাে সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে! লাগাও জুতি! এই বলে এক-চোট অপমান তাে হয়েই গেল, তার পরে একশাে টাকা জরিমানা। এরাই সন্দীপের পিছনে পিছনে চীৎকার করে বেড়ায়, বন্দে মাতরং। এরা দেশের সেবক!