পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০
ঘরে-বাইরে

ও অমাবস্যার চাঁদ; চাঁদই বটে, কিন্তু ঘটনাক্রমে পূর্ণিমার উলটো দিকে গিয়ে পড়েছে।

 আমি বললুম, সেইজন্যে চিরদিনই ওর সঙ্গে আমার মতের মিল নেই, কিন্তু ওর প্রতি আমার স্বভাবের আকর্ষণ আছে। ও আমার অনেক ক্ষতি করেছে, আরাে করবে, কিন্তু ওকে আমি অশ্রদ্ধা করতে পারি নে।

 তিনি বললেন, সে আমি ক্রমে বুঝতে পারছি। আমি অনেক দিন আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি সন্দীপকে এতদিন তুমি কেমন করে সহ্য করে আছ। এমন-কি, এক-এক দিন আমার সন্দেহ হয়েছে, এর মধ্যে তােমার দুর্বলতা আছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, ওর সঙ্গে তােমার কথারই মিল নেই, কিন্তু ছন্দের মিল রয়েছে।

 আমি কৌতুক করে বললুম, মিত্রে মিত্রে মিলে অমিত্রাক্ষর। হয়তাে আমাদের ভাগ্যকবি ‘প্যারাডাইস লস্ট’এর মতাে একটা এপিক লেখবার সংকল্প করেছেন।

 মাস্টারমশায় বললেন, এখন পঞ্চুকে নিয়ে কী করা যায়।

 আমি বললুম, আপনি বলেছিলেন, যে বিঘে-কয়েক জমির উপর পঞ্চুর বাড়ি আছে সেটাতে অনেক দিন থেকে ওর মৌরসি স্বত্ব জন্মেছে, সেই স্বত্ব কাঁচিয়ে দেবার জন্যে ওর জমিদার অনেক চেষ্টা করেছে। ওর সেই জমিটা আমি কিনে নিয়ে সেইখানেই ওকে আমার প্রজা করে রেখে দিই।

 আর, ওর একশাে টাকার জরিমানা?

 সে জরিমানার টাকা কিসের থেকে আদায় হবে? জমি যে আমার হবে।

 আর, ওর কাপড়ের বস্তা?

 আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার প্রজা হয়ে ও যেমন ইচ্ছে বিক্রি করুক, দেখি ওকে কে বাধা দেয়।

 পঞ্চু হাত জোড় করে বললে, হুজুর, রাজায় রাজায় লড়াই— পুলিসের দারােগা থেকে উকিল ব্যারিস্টার পর্যন্ত শকুনি-গৃধিনীর পাল জমে যাবে; সবাই দেখে আমােদ করবে, কিন্তু মরবার বেলায় আমিই মরব।

 কেন, তাের কী করবে?

 ঘরে আমার আগুন লাগিয়ে দেবে, ছেলেমেয়ে সুদ্ধু নিয়ে পুড়ব।

 মাস্টারমশায় বললেন, আচ্ছা, তাের ছেলেমেয়েরা কিছুদিন আমার ঘরেই থাকবে; তুই ভয় করিস নে। তাের ঘরে বসে তুই যেমন ইচ্ছে ব্যবসা কর, কেউ তাের গায়ে হাত দিতে পারবে না। অন্যায়ের কাছে তুই হার মেনে পালাবি, এ আমি হতে দেব না। যত সইব বােঝা ততই বাড়বে।