পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
ঘরে-বাইরে

বেগে ঘােরাতে ঘােরাতে বলল, দেখাে, সমস্ত বাংলাদেশের মধ্যে কেবল আমাদের এই হাটটার মধ্যেই বিলিতি কাপড় আসছে, এটা কি ভালাে হচ্ছে?

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কী করলে ভালাে হয়?

 ঐ জিনিসগুলাে বের করে দিতে বলাে-না।

 জিনিসগুলাে তাে আমার নয়।

 কিন্তু, হাট তাে তােমার।

 হাট আমার চেয়ে তাদের অনেক বেশি যারা ঐ হাটে জিনিস কিনতে আসে।

 তারা দিশি জিনিস কিনুক-না।

 যদি কেনে তাে আমি খুশি হব, কিন্তু যদি না কেনে?

 সে কী কথা! ওদের এত বড় আস্পর্ধা হবে? তুমি হলে—

 আমার সময় অল্প, এ নিয়ে তর্ক করে কী হবে? আমি অত্যাচার করতে পারব না।

 অত্যাচার তাে তােমার নিজের জন্যে নয়, দেশের জন্যে—

 দেশের জন্যে অত্যাচার করা দেশের উপরেই অত্যাচার করা। সে কথা তুমি বুঝতে পারবে না।

 এই বলে আমি চলে এলুম। হঠাৎ আমার চোখের সামনে সমস্ত জগৎ যেন দীপ্যমান হয়ে উঠল। মাটির পৃথিবীর ভার যেন চলে গেছে, সে যে আপনার জীবপালনের সমস্ত কাজ করেও আপনার নিরন্তর বিকাশের সমস্ত পর্যায়ের ভিতরেও একটি অদ্ভুত শক্তির বেগে দিনরাত্রিকে জপমালার মতাে ফেরাতে ফেরাতে যুগে যুগে আকাশের মধ্যে ছুটে চলেছে, সেইটে আমি আমার রক্তের মধ্যে অনুভব করলুম। কর্মভারের সীমা নেই, অথচ মুক্তিবেগেরও সীমা নেই। কেউ বাঁধবে না, কেউ বাঁধবে না, কিছুতেই বাঁধবে না। অকস্মাৎ আমার মনের গভীরতা থেকে একটা বিপুল আনন্দ যেন সমুদ্রের জলস্তম্ভের মতাে আকাশের মেঘকে গিয়ে স্পর্শ করলে।

 নিজেকে বার বার জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ তােমার এ হল কী?

 প্রথমটা স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না; তার পরে পরিষ্কার বুঝলুম, এই কয়দিন যে বন্ধন দিনরাত আমার মনের ভিতরে এমন পীড়া দিয়েছে আজ তার একটা মস্ত ফাঁক দেখা গেল। আমি ভারি আশ্চর্য হলুম, আমার মনের মধ্যে কোনাে ঘাের ছিল না। ফোটোগ্রাফের প্লেটে যেরকম করে ছবি পড়ে আমার দৃষ্টিতে বিমলার সমস্ত কিছু তেমনি করে অঙ্কিত হল। আমি স্পষ্ট করে দেখতে পেলুম, বিমলা আমার কাছ থেকে কাজ আদায় করবার জন্যে বিশেষ করে সাজ করেছে। আজকের দিনের পূর্ব পর্যন্ত আমি কখনােই