পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৪
ঘরে-বাইরে

 যে প্রকাণ্ড তামসিকতা এক দিকে উপবাসে কৃশ, অজ্ঞানে অন্ধ, অবসাদে জীর্ণ, আর-এক দিকে মুমূর্ষুর রক্তশোষণে স্ফীত হয়ে আপনার অবিচলিত জড়ত্বের তলায় ধরিত্রীকে পীড়িত করে পড়ে আছে, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে— এই কাজটা মুলতবি হয়ে পড়ে রয়েছে শত শত বৎসর ধরে। আমার মোহ ঘুচুক, আমার আবরণ কেটে যাক, আমার পৌরুষ অন্তঃপুরের স্বপ্নের জালে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়ে থাকে না যেন। আমরা পুরুষ, মুক্তিই আমাদের সাধনা; আইডিয়ালের ডাক শুনে আমরা সামনের দিকে ছুটে চলে যাব, দৈত্যপুরীর দেয়াল ডিঙিয়ে বন্দিনী লক্ষ্মীকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে হবে— যে মেয়ে তার নিপুণ হাতে আমাদের সেই অভিযানের জয়পতাকা তৈরি করে দিচ্ছে সেই আমাদের সহধর্মিণী। আর, ঘরের কোণে যে আমাদের মায়াজাল বুনছে তার ছদ্মবেশ ছিন্ন করে তার মোহমুক্ত সত্যকার পরিচয় যেন পাই, তাকে আমাদের নিজেরই কামনার রসে রঙে অপ্সরী সাজিয়ে তুলে যেন নিজের তপস্যাভঙ্গ করতে না পাঠাই। আজ আমার মনে হচ্ছে, আমার জয় হবে— আমি সহজের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। সহজ চোখে সব দেখছি। আমি মুক্তি পেয়েছি, আমি মুক্তি দিলুম। যেখানে আমার কাজ সেইখানেই আমার উদ্ধার।

 আমি জানি, বেদনায় বুকের নাড়ীগুলা আবার এক-এক দিন টন্ টন্ করে উঠবে। কিন্তু সেই বেদনাকেও আমি এবার চিনে নিয়েছি। তাকে আমি আর শ্রদ্ধা করতে পারব না। আমি জানি, সে কেবলমাত্রই আমার; তার দাম কিসের! যে দুঃখ বিশ্বের সেই তো আমার গলার হার হবে। হে সত্য, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও; কিছুতেই আমাকে ফিরে যেতে দিয়ো না ছলনার ছদ্মস্বর্গলোকে। আমাকে একলা-পথের পথিক যদি কর সে পথ তোমারই পথ হোক; আমার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে তোমার জয়ভেরী বেজেছে আজ।