পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৬
ঘরে-বাইরে

দিকে কোথায় কী বাধা লুকিয়ে ছিল মকরবাহিনী নিজেও তা জানত না। আমি বিমলার হাত চেপে ধরলুম, আমার দেহবীণার ছােটো বড়াে সমস্ত তার ভিতরে ভিতরে ঝংকার দিয়ে উঠল। কিন্তু ঐ অস্থায়ীতেই কেন থেমে গেল! অন্তরা পর্যন্ত কেন পৌছল না! বুঝতে পারলুম, জীবনের স্রোতঃপথের গভীরতম তলাটা বহুকালের গতি দিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। ইচ্ছার বন্যা যখন প্রবল হয়ে বয় তখন সেই তলার পথটাকে কোথাও বা ভাঙে, আবার কোথাও বা এসে ঠেকে যায়। ভিতরে একটা সংকোচ কোথাও রয়ে গেছে, সেটা কী? সে কোনাে-একটা জিনিস নয়, সে অনেকগুলােতে জড়ানাে। সেইজন্যে তার চেহারা স্পষ্ট বুঝতে পারি নে; এই কেবল বুঝি, সেটা একটা বাধা। এই বুঝি আমি আসলে যা তা আদালতের সাক্ষ্য-দ্বারা কোনাে কালে পাকা দলিলে প্রমাণ হবে না। আমি নিজের কাছে নিজে রহস্য; সেইজন্যেই নিজের উপর এমন প্রবল টান— ওকে আগাগােড়া সম্পূর্ণ চিনে ফেললেই ওকে টান মেরে ফেলে দিয়ে একেবারে তুরীয় অবস্থা হয়ে যেত।

 চৌকিতে বসে দেখতে দেখতে বিমলার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মনে মনে সে বুঝলে, তার একটা ফাঁড়া কেটে গেল। ধূমকেতু তাে পাশ দিয়ে সোঁ করে চলে গেল, কিন্তু তার আগুনের পুচ্ছের ধাক্কায় ওর মনপ্রাণ কিছুক্ষণের জন্যে যেন মূর্ছিত হয়ে পড়ল। আমি এই ঘােরটাকে কাটিয়ে দেবার জন্যে বললুম, বাধা আছে; কিন্তু তা নিয়ে খেদ করব না, লড়াই করব। কী বল, রানী?

 বিমলা একটু কেশে তার বদ্ধ স্বরকে কিছু পরিষ্কার করে নিয়ে শুধু বললে, হ্যাঁ।

 আমি বললুম, কী করে কাজটা আরম্ভ করতে হবে তারই প্ল্যানটা একটু স্পষ্ট করে ঠিক করে নেওয়া যাক।

 বলে আমি আমার পকেট থেকে পেন্‌সিল-কাগজ বের করে নিয়ে বসলুম। কলকাতা থেকে আমাদের দলের যে-সব ছেলে এসে পড়েছে তাদের মধ্যে কিরকম কাজের বিভাগ করে দিতে হবে তারই আলােচনা করতে লাগলুম—এমন সময়ে হঠাৎ মাঝখানে বিমলা বলে উঠল, এখন থাক্ সন্দীপবাবু, আমি পাঁচটার সময় আসব, তখন সব কথা হবে।

 এই বলেই সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

 বুঝলুম, এতক্ষণ চেষ্টা করে কিছুতে আমার কথায় বিমলা মন দিতে পারছিল না; নিজের মনটাকে নিয়ে এখন কিছুক্ষণ ওর একলা থাকা চাই। হয়তাে বিছানায় পড়ে ওকে কাঁদতে হবে।