পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৬
ঘরে-বাইরে

সত্য থেকে সে ভ্রষ্ট হবে। দেশের প্রতিমাকে যে লােক সত্য বলে মানতে পারে দেশের প্রতিমা তার মধ্যে সত্যের মতােই কাজ করবে। আমাদের যেরকমের স্বভাব কিংবা সংস্কার তাতে আমরা দেশকে সহজে মানতে পারি নে, কিন্তু দেশের প্রতিমাকে অনায়াসে মানতে পারি। এটা যখন জানা কথা তখন যারা কাজ উদ্ধার করতে চায় তারা এইটে বুঝেই কাজ করবে।

 নিখিল হঠাৎ ভারি উত্তেজিত হয়ে উঠে বললে, সত্যের সাধনা করবার শক্তি তােমরা খুইয়েছ বলেই তােমরা হঠাৎ আকাশ থেকে একটা মস্ত ফল পেতে চাও। তাই শত শত বৎসর ধরে দেশের যখন সকল কাজই বাকি তখন তােমরা দেশকে দেবতা বানিয়ে বর পাবার জন্যে হাত পেতে বসে রয়েছ।

 আমি বললুম, অসাধ্য সাধন করা চাই, সেইজন্যেই দেশকে দেবতা করা দরকার।

 নিখিল বললে, অর্থাৎ সাধ্যের সাধনায় তােমাদের মন উঠছে না। যা-কিছু আছে সমস্ত এমনিই থাকবে, কেবল তার ফলটা হবে আজগুবি।

আমি বললুম, নিখিল, তুমি যা বলছ ওগুলাে উপদেশ। একটা বিশেষ বয়সে ওর দরকার থাকতে পারে কিন্তু মানুষের যখন দাঁত ওঠে তখন ও চলবে না। স্পষ্টই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কোনােদিন স্বপ্নেও যার আবাদ করি নি সেই ফসল হুহু করে ফলে উঠছে। কিসের জোরে? আজ দেশকে দেবতা বলে মনের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি বলে। এইটেকেই মূর্তি দিয়ে চিরন্তন করে তােলা এখনকার প্রতিভার কাজ। প্রতিভা তর্ক করে না, সৃষ্টি করে। আজ দেশ যা ভাবছে আমি তাকে রূপ দেব। আমি ঘরে ঘরে গিয়ে বলে বেড়াব, দেবী আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন, তিনি পুজো চান। আমরা ব্রাহ্মণদের গিয়ে বলব, দেবীর পূজারি তােমরাই, সেই পুজো বন্ধ আছে বলেই তােমরা নামতে বসেছ। তুমি বলবে, আমি মিথ্যা বলছি। না, এ সত্য। আমার মুখ থেকে এ কথাটি শোেনবার জন্যে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ লােক অপেক্ষা করে রয়েছে; সেইজন্যই বলছি, এ কথা সত্য। যদি আমার বাণী আমি প্রচার করতে পারি তা হলে তুমি দেখতে পাবে এর আশ্চর্য ফল।

 নিখিল বললে, আমার আয়ু কতদিনই বা। তুমি যে ফল দেশের হাতে তুলে দেবে তারও পরের ফল আছে, সেটা হয়তাে এখন দেখা যাবে না।

 আমি বললুম, আমি আজকের দিনের ফলটা চাই, সেই ফলটাই আমার।

 নিখিল বললে, আমি কালকের দিনের ফলটা চাই, সেই ফলটাই সকলের।