পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১২৭

 আসল কথা, বাঙালির যে একটা বড়াে ঐশ্বর্য আছে, কল্পনাবৃত্তি, সেটা হয়তাে নিখিলের ছিল, কিন্তু বাইরের থেকে একটা ধর্মবৃত্তির বনস্পতি বড়াে হয়ে উঠে ওটাকে নিজের আওতায় মেরে ফেললে বলে। ভারতবর্ষে এই-যে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর পূজা বাঙালি উদ্‌ভাবন করেছে এইটেতে সে নিজের আশ্চর্য পরিচয় দিয়েছে। আমি নিশ্চয় বলতে পারি, এ দেবী পােলিটিক্যাল দেবী। মুসলমানের শাসনকালে বাঙালি যে দেশ-শক্তির কাছ থেকে শত্রুজয়ের বর কামনা করেছিল এ দুই দেবী তারই দুই রকমের মূর্তি। সাধনার এমন আশ্চর্য বাহ্য রূপ ভারতবর্ষের আর কোন্ জাত গড়তে পেরেছে।

 কল্পনার দিব্যদৃষ্টি নিখিলের একেবারেই অন্ধ হয়ে গেছে বলেই সে আমাকে অনায়াসে বলতে পারলে, মুসলমান-শাসনে বর্গি বলাে, শিখ বলাে, নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে ফল চেয়েছিল, বাঙালি তার দেবমূর্তির হাতে অস্ত্র দিয়ে মন্ত্র পড়ে ফল কামনা করেছিল কিন্তু দেশ দেবী নয়, তাই ফলের মধ্যে কেবল ছাগমহিষের মুণ্ডপাত হল। যেদিন কল্যাণের পথে দেশের কাজ করতে থাকব সেইদিনই যিনি দেশের চেয়ে বড়াে, যিনি সত্য দেবতা, তিনি সত্য ফল দেবেন।

 মুশকিল হচ্ছে, কাগজে কলমে লিখলে নিখিলের কথা শােনায় ভালাে। কিন্তু আমার কথা কাগজে লেখবার নয়, লােহার খন্তা দিয়ে দেশের বুক চিরে চিরে লেখবার। পণ্ডিত যেরকম কৃষিতত্ত্ব ছাপার কালিতে লেখে সেরকম নয়, লাঙলের ফলা দিয়ে চাষী যেরকম মাটির বুকে আপনার কামনা অঙ্কিত করে সেইরকম।


বিমলার সঙ্গে যখন আমার দেখা হল, আমি বললুম, যে দেবতার সাধনা করবার জন্যে লক্ষ যুগের পর পৃথিবীতে এসেছি, তিনি যতক্ষণ আমাকে প্রত্যক্ষ না দেখা দিয়েছেন ততক্ষণ তাঁকে আমার সমস্ত দেহ মন দিয়ে কি বিশ্বাস করতে পেরেছি? তােমাকে যদি না দেখতুম তা হলে আমার সমস্ত দেশকে আমি এক করে দেখতে পেতুম না, এ কথা আমি তােমাকে কতবার বলেছি; জানি নে তুমি আমার কথা ঠিকমত বুঝতে পার কি না। এ কথা বােঝানাে ভারি শক্ত যে, দেবলােকে দেবতারা থাকেন অদৃশ্য, মর্ত্যলােকেই তাঁরা দেখা দেন।

 বিমলা একরকম করে আমার দিকে চেয়ে বললে, তােমার কথা খুব স্পষ্টই বুঝতে পেরেছি।

 এই প্রথম বিমলা আমাকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ বললে।