পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৪
ঘরে-বাইরে

উপরে চলেছেন। যারা স্বভাবতই দাস, প্রভু না থাকাটাই হচ্ছে তাদের সকলের চেয়ে বড়াে বিপদ।

 এফ. এ. প্লাক্‌ড্ ছােকরাটি বললে, একটা ঘটনা জানি। চক্রবর্তীদের একটি কায়স্থ প্রজা ছিল। সে তার একটা হাট নিয়ে চক্রবর্তীদের কিছুতে মানছিল না। মামলা করতে করতে শেষকালে তার এমন দশা হল যে খেতে পায় না। যখন দুদিন তার ঘরে হাঁড়ি চড়ল না তখন স্ত্রীর রুপাের গয়না বেচতে বেরােলাে; এই তার শেষ সম্বল। জমিদারের শাসনে গ্রামের কেউ তার গয়না কিনতেও সাহস করে না। জমিদারের নায়েব বললে, আমি কিনব, পাঁচ টাকা দামে। দাম তার টাকা ত্রিশ হবে। প্রাণের দায়ে পাঁচ টাকাতেই যখন সে রাজি হল তখন তার গয়নার পুঁটুলি নিয়ে নায়েব বললে, এই পাঁচ টাকা তােমার খাজনা-বাকিতে জমা করে নিলুম।— এই কথা শুনে আমরা সন্দীপবাবুকে বলেছিলুম, চক্রবর্তীকে আমরা বয়কট করব! সন্দীপবাবু বললেন, এই সমস্ত জ্যান্ত লােককেই যদি বাদ দাও তা হলে কি ঘাটের মড়া নিয়ে দেশের কাজ করবে? এরা প্রাণপণে ইচ্ছা করতে জানে; এরাই তাে প্রভু। যারা যােলাে-আনা ইচ্ছে করতে জানে না, তারা হয় এদের ইচ্ছেয় চলবে নয় এদের ইচ্ছেয় মরবে। তিনি আপনার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, আজ চক্রবর্তীর এলেকায় একটি মানুষ নেই যে স্বদেশী নিয়ে টুঁ শব্দটি করতে পারে, অথচ নিখিলেশ হাজার ইচ্ছে করলেও স্বদেশী চালাতে পারবেন না।

 আমি বললুম, আমি স্বদেশীর চেয়ে বড়াে জিনিস চালাতে চাই, সেইজন্যে স্বদেশী চালানাে আমার পক্ষে শক্ত। আমি মরা খুঁটি চাই নে তাে, আমি জ্যান্ত গাছ চাই। আমার কাজে দেরি হবে।

 ঐতিহাসিক হেসে বললেন, আপনি মরা খুঁটিও পাবেন না, জ্যান্ত গাছও পাবেন না। কেননা, সন্দীপবাবুর কথা আমি মানি— পাওয়া মানেই কেড়ে নেওয়া। এ কথা শিখতে আমাদের সময় লেগেছে, কেননা এগুলাে ইস্কুলের শিক্ষার উলটো শিক্ষা। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কুণ্ডুদের গােমস্তা গুরুচরণ ভাদুড়ি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল— একটা মুসলমান প্রজার বেচে-কিনে নেবার মতাে কিছু ছিল না। ছিল তার যুবতী স্ত্রী। ভাদুড়ি বললে, তাের বউকে নিকে দিয়ে টাকা শােধ করতে হবে। নিকে করবার উমেদার জুটে গেল, টাকাও শােধ হল। আপনাকে বলছি, স্বামীটার চোখের জল দেখে আমার রাত্রে ঘুম হয় নি। কিন্তু যতই কষ্ট হােক, আমি এটা শিখেছি যে, যখন টাকা আদায় করতেই হবে তখন যে মানুষ ঋণীর স্ত্রীকে বেচিয়ে টাকা