পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৩৫

সংগ্রহ করতে পারে মানুষ-হিসাবে সে আমার চেয়ে বড়াে— আমি পারি নে, আমার চোখে জল আসে, তাই সব ফেঁসে যায়। আমার দেশকে যদি কেউ বাঁচায় তবে এই-সব গােমস্তা, ঐ-সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীরা।

 আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম; বললুম, তাই যদি হয় তবে এই-সব গােমস্তা, এই-সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার কাজই আমার। দেখাে, দাসত্বের যে বিষ মজ্জার মধ্যে আছে সেইটেই যখন সুযােগ পেয়ে বাইরে ফুটে ওঠে তখনই সেটা সাংঘাতিক দৌরাত্মের আকার ধরে। বউ হয়ে যে মার খায় শাশুড়ি হয়ে সেই সব চেয়ে বড়াে মার মারে। সমাজে যে মানুষ মাথা হেঁট করে থাকে সে যখন বরযাত্র হয়ে বেরােয় তখন তার উৎপাতে মানী গৃহস্থের মান রক্ষা করা অসাধ্য। ভয়ের শাসনে তােমরা নির্বিচারে কেবলই সকল-তাতেই সকলকে মেনে এসেছ, সেইটেকেই ধর্ম বলতে শিখেছ, সেইজন্যেই আজকে অত্যাচার করে সকলকে মানানােটাকেই তােমরা ধর্ম বলে মনে করছ। আমার লড়াই দুর্বলতার ঐ নিদারুণতার সঙ্গে।

 আমার এ-সব কথা অত্যন্ত সহজ কথা— সরল লােককে বললে বুঝতে তার মুহূর্তমাত্র দেরি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে যে-সব এম. এ. ঐতিহাসিক বুদ্ধির প্যাঁচ কষছে, সত্যকে পরাস্ত করবার জন্যেই তাদের প্যাঁচ।

 এ দিকে পঞ্চুর জাল মামীকে নিয়ে ভাবছি। তাকে অপ্রমাণ করা কঠিন। সত্য ঘটনার সাক্ষীর সংখ্যা পরিমিত, এমন-কি, সাক্ষী না থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটে নি, জোগাড় করতে পারলে তার সাক্ষীর অভাব হয় না। আমি যে মৌরসি স্বত্ব পঞ্চুর কাছ থেকে কিনেছি সেইটে কাঁচিয়ে দেবার এই ফন্দি।

 আমি নিরুপায় দেখে ভাবছিলুম পঞ্চুকে আমার নিজ এলাকাতেই জমি দিয়ে ঘরবাড়ি করিয়ে দিই। কিন্তু মাস্টারমশাই বললেন, অন্যায়ের কাছে সহজে হার মানতে পারব না। আমি নিজে চেষ্টা দেখব।

 আপনি চেষ্টা দেখবেন?

 হাঁ, আমি।

 এ-সমস্ত মামলা-মকদ্দমার ব্যাপার— মাস্টারমশাই যে কী করতে পারেন বুঝতে পারলুম না। সন্ধ্যাবেলায় যে সময়ে রােজ আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় সেদিন দেখা হল না। খবর নিয়ে জানলুম তিনি তাঁর কাপড়ের বাক্স আর বিছানা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন; চাকরদের কেবল এইটুকু বলে গেছেন, তাঁর ফিরতে দু-চার দিন দেরি হবে। আমি ভাবলুম সাক্ষী সংগ্রহ করবার জন্য তিনি পঞ্চুদের মামার বাড়িতেই-বা চলে গেছেন। তা যদি হয় আমি জানি,