পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৩৭

গাছ ভরে ফুল উঠত তখন মনে হত, সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে রঙের ফেনা উঠেছে। কিছু কাল আমি বাগানে যাই নি; আজ মনে মনে একটু হেসে বললুম, আমার বিরহিণী চন্দ্রমল্লিকার বিরহ ঘুচিয়ে আসি গে।

 বাগানে যখন ঢুকলুম তখন কৃষ্ণ-প্রতিপদের চাঁদটি ঠিক আমাদের পাঁচিলের উপরটিতে এসে মুখ বাড়িয়েছে। পাঁচিলের তলাটিতে নিবিড় ছায়া, তারই উপর দিয়ে বাঁকা চাঁদের আলাে বাগানের পশ্চিম দিকে এসে পড়েছে। ঠিক আমার মনে হল, চাঁদ যেন হঠাৎ পিছন দিক থেকে এসে অন্ধকারের চোখ টিপে ধরে মুচকে হাসছে।

 পাঁচিলে যে ধারটিতে গ্যালারির মতাে করে থাকে থাকে চন্দ্রমল্লিকার টব সাজানাে রয়েছে সেই দিকে গিয়ে দেখি, সেই পুষ্পিত সােপানশ্রেণীর তলায় ঘাসের উপরে কে চুপ করে শুয়ে আছে। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস্ করে উঠল। আমি কাছে যেতেই সেও চমকে তাড়াতাড়ি উঠে বসল।

 তার পর কী করা যায়! আমি ভাবছি, আমি এইখান থেকে ফিরে যাব কিনা। বিমলাও নিশ্চয় ভাবছিল, সে উঠে চলে যাবে কিনা। কিন্তু থাকাও যেমন শক্ত চলে যাওয়াও তেমনি। আমি কিছু-একটা মনস্থির করার পূর্বেই বিমলা উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ির দিকে চলল।

 সেই একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিমলার দুর্বিষহ দুঃখ আমার কাছে যেন মূর্তিমান হয়ে দেখা দিল। সেই মুহূর্তে আমার নিজের জীবনের নালিশ কোথায় দূরে ভেসে গেল। আমি তাকে ডাকলুম, বিমলা!

 সে চমকে দাঁড়ালাে। কিন্তু তখনাে সে আমার দিকে ফিরল না। আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালুম। তার দিকে ছায়া, আমার মুখের উপর চাঁদের আলাে পড়ল। সে দুই হাত মুঠো করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললুম, বিমলা, আমার এই পিঁজরের মধ্যে চারি দিক বন্ধ, তােমাকে কিসের জন্যে এখানে ধরে রাখব? এমন করে তাে তুমি বাঁচবে না!

 বিমলা চোখ বুজেই রইল, একটি কথাও বললে না।

 আমি বললুম, তােমাকে যদি এমন জোর করে বেঁধে রাখি তা হলে আমার সমস্ত জীবন যে একটা লােহার শিকল হয়ে উঠবে। তাতে কি আমার কোনাে সুখ আছে?

 বিমলা চুপ করেই রইল।

 আমি বললুম, এই আমি তােমাকে সত্য বলছি, আমি তােমাকে ছুটি দিলুম। আমি যদি তােমার আর-কিছু না হতে পারি, অন্তত আমি তােমার হাতের হাত-কড়া হব না।