পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৪৫

 অমূল্যকে বললুম, যাও তােমাকে কিছু করতে হবে না; টাকা সংগ্রহ করার ভার আমারই উপর।

 যখন সে দরজা পর্যন্ত গেছে তখন তাকে ডাক দিয়ে ফেরালুম; বললুম, অমূল্য, আমি তােমার দিদি। আজ ভাইফোঁটার পাঁজির তিথি নয়, কিন্তু ভাইফোঁটার আসল তিথি বছরে তিনশাে পয়ষট্টি দিন। আমি তােমাকে আশীর্বাদ করছি, ভগবান তােমাকে রক্ষা করুন।

 হঠাৎ আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে অমূল্য একটু থমকে রইল। তার পরেই প্রণাম করে আমার পায়ের ধুলাে নিলে। উঠে যখন দাঁড়ালাে তার চোখ ছল্‌ছল্‌ করছে। ভাই আমার, আমি তাে মরতেই বসেছি— তােমার সব বালাই নিয়ে যেন মরি— আমা হতে তােমার কোনাে অপরাধ যেন না হয়।

 অমূল্যকে বললুম, তােমার পিস্তলটি আমাকে প্রণামী দিতে হবে।

 কী করবে দিদি?

 মরণ প্র্যাক্‌টিস করব।

 এই তাে চাই দিদি, মেয়েদেরও মরতে হবে, মারতে হবে। এই বে অমূল্য পিস্তলটি আমার হাতে দিল।

 অমূল্য তার তরুণ মুখের দীপ্তিরেখা আমার জীবনের মধ্যে নূতন ঊষার প্রথম অরুণলেখাটির মতাে এঁকে দিয়ে গেল। পিস্তলটাকে বুকের কাপড়ের ভিতর নিয়ে বললুম, এই রইল আমার উদ্ধারের শেষ সম্বল, আমার ভাইফোঁটার প্রণামী।

 নারী-হৃদয়ে যেখানে মায়ের আসন আমার সেইখানকার জানলাটি হঠাৎ এই একবার খুলে গিয়েছিল। তখন মনে হল, এখন থেকে বুঝি তবে খােলাই রইল।

 কিন্তু, শ্রেয়ের পথ আবার বন্ধ হয়ে গেল, প্রেয়সী নারী এসে মাতার স্বস্ত্যয়নের ঘরে তালা লাগিয়ে দিলে।

 পরের দিন সন্দীপের সঙ্গে আবার দেখা। একটা উলঙ্গ পাগলামি আবার হৃৎপিণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করে দিলে। কিন্তু এ কী এ!

 এই কি আমার স্বভাব! কখনােই না।

 এই নির্লজ্জকে, এই নিদারুণকে এর আগে কোনােদিন দেখি নি। সাপুড়ে হঠাৎ এসে এই সাপকে আমার আঁচলের ভিতর থেকে বের করে দেখিয়ে দিলে। কিন্তু কখনােই এ আমার আঁচলের মধ্যে ছিল না, এ ঐ সাপুড়েরই চাদরের ভিতরকার জিনিস। অপদেবতা কেমন করে আমার উপর ভর করেছে। আজ আমি যা-কিছু করছি সে আমার নয়, সে তারই লীলা।