পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৪৯

 আমি চোরের মতােই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

 আমি ঠাকুরপােকে বলছিলুম তােমার শরণাপন্ন হতে। দেবী, প্রসন্ন হও গাে, তােমার দলবল ঠেকাও। আমরা তােমার বন্দে মাতরমের শিন্নি মানছি। দেখতে দেখতে অনেক কাণ্ডই তাে হল; এখন দোহাই তােমার, ঘরে সিঁদটা ঘটতে দিয়াে না।

 আমি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি আমার শােবার ঘরে চলে গেলুম। চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছি, আর ওঠবার জো নেই, এখন যত ছট্‌ফট্‌ করব ততই ডুবতে থাকব।

 এ টাকাটা এক্ষনি আমার আঁচল থেকে খসিয়ে সন্দীপের হাতে দিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচি। এ বােঝা আমি আর বইতে পারি নে, আমার পাঁজর যেন ভেঙে যাচ্ছে।

 সকালবেলাতেই খবর পেলুম, সন্দীপ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আজ আর আমার সাজসজ্জা ছিল না— শাল মুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলুম।

 ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি, সন্দীপের সঙ্গে অমূল্য বসে আছে। মনে হল, আমার মানসম্ভ্রম যা-কিছু বাকি ছিল সমস্ত যেন ঝিম্ ঝিম্ করে আমার গা বেয়ে নেবে গিয়ে পায়ের তলা দিয়ে একেবারে মাটির মধ্যে চলে গেল। নারীর চরম অমর্যাদা ঐ বালকের সামনে আজ আমাকে উদ্‌ঘাটিত করে দিতে হবে। আমার এই চুরির কথা এরা আজ দলের মধ্যে বসে আলােচনা করছে! এর উপরে অল্প একটুখানিও আব্‌রু রাখতে দেয় নি।

 পুরুষ-মানুষকে আমরা বুঝব না। ওরা যখন ওদের উদ্দেশ্যের রথ টানবার পথ তৈরি করতে বসে তখন বিশ্বের হৃদয়কে টুকরাে টুকরাে করে ভেঙে পথের খােওয়া বিছিয়ে দিতে ওদের একটুও বাধে না। ওরা নিজের হাতে সৃষ্টি করবার নেশায় যখন মেতে ওঠে তখন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে চুরমার করতেই ওদের আনন্দ। আমার এই মর্মান্তিক লজ্জা ওদের চোখের কোণেও পড়বে না; প্রাণের ’পরে দরদ নেই ওদের, ওদের যত ব্যগ্রতা সব উদ্দেশ্যের দিকে। হায় রে, এদের কাছে আমি কেই বা! বন্যার মুখের কাছে একটা মেঠো ফুলের মতাে।

 কিন্তু আমাকে এমন করে নিবিয়ে ফেলে সন্দীপের লাভ হল কী? এই পাঁচ হাজার টাকা? কিন্তু আমার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না কি? ছিল বৈকি। সেই খবরই তাে সন্দীপের কাছে শুনেছিলুম, আর সেই শুনেই তাে আমি সংসারের সমস্তকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলুম। আমি