পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৪
ঘরে-বাইরে

 আর থাকতে পারলুম না, তখনই বাড়ি-ভিতরে মেজোরানীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তিনি তখন বারান্দায় রােদ্‌দুরে বসে পান সাজছেন, পাশে থাকো বসে। থাকোকে দেখে মুহূর্তের জন্যে মনটা সংকুচিত হল, তখনই সেটা কাটিয়ে নিয়ে মেজোরানীর পায়ের কাছে পড়ে তাঁর পায়ের ধুলাে নিলুম।

 তিনি বলে উঠলেন, ও কী লাে ছােটোরানী, তাের হল কী? হঠাৎ এত ভক্তি কেন!

 আমি বললুম, দিদি, আজ আমার জন্মতিথি। অনেক অপরাধ করেছি। করাে দিদি, আশীর্বাদ করাে, আর যেন কোনােদিন তােমাদের কোনাে দুঃখ না দিই। আমার ভারি ছােটো মন।

 বলেই তাঁকে আবার প্রণাম করে তাড়াতাড়ি উঠে এলুম। তিনি পিছন থেকে বলতে লাগলেন, বলি ও ছুটু, তাের জন্মতিথি, এ কথা আগে বলিস নি কেন? আমার এখানে দুপুরবেলা তাের নেমন্তন্ন রইল। লক্ষ্মী বােন, ভুলিস নে।

 ভগবান, এমন কিছু করাে যাতে আজ আমার জন্মতিথি হয়। একেবারে নতুন হতে পারি নে কি? সব ধুয়ে মুছে আর-একবার গােড়া থেকে পরীক্ষা করাে প্রভু।

 বাইরের বৈঠকখানা-ঘরে যখন ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় সেখানে সন্দীপ এসে উপস্থিত হল। বিতৃষ্ণায় সমস্ত মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। আজ সকালের আলােয় তার যে মুখ দেখলুম তাতে প্রতিভার জাদু একটুও ছিল না। আমি বলে উঠলুম, আপনি যান এখান থেকে।

 সন্দীপ হেসে বললে, অমূল্য তাে নেই, এবার বিশেষ কথার পালা যে আমার।

 পােড়া কপাল! যে অধিকার আমিই দিয়েছি সে অধিকার আজ ঠেকাই কী করে? বললুম, আমার একলা থাকবার দরকার আছে।

 রানী, আর-একজন লােক ঘরে থাকলেও একলা থাকার ব্যাঘাত হয় না। আমাকে তুমি মনে কোরাে না ভিড়ের লােক— আমি সন্দীপ, লক্ষ লােকের মাঝেও আমি একলা।

 আপনি আর-এক সময় আসবেন, আজ সকালে আমি—

 অমূল্যর জন্যে অপেক্ষা করছেন?

 আমি বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উদ্‌যােগ করছি, এমন সময় সন্দীপ তার শালের ভিতর থেকে আমার গয়নার বাক্স বের করে ঠক্ করে পাথরের টেবিলের উপর রাখলে।