পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮০
ঘরে-বাইরে

মন্ত্রসিদ্ধ। মক্ষীরানী, সংসারে সব চেয়ে বড়াে লড়াই এই মন্ত্রের লড়াই। সম্মােহনে সম্মােহনে কাটাকাটি। এক বাণ শব্দভেদী বাণ। আবার নিঃশব্দভেদী বাণও আছে। এতদিন পরে এ লড়াইয়ে সন্দীপের সমকক্ষ মিলেছে। তােমার তূণে অনেক বাণ আছে রণরঙ্গিণী! পৃথিবীর মধ্যে দেখলুম, কেবল তুমিই সন্দীপকে আপন ইচ্ছামতে ফেরাতে পারলে, আবার আপন ইচ্ছামতে টেনে আনলে। শিকার তাে এসে পড়ল। এখন একে নিয়ে কী করবে বলাে? একেবারে নিঃশেষে মারবে, না তােমার খাঁচায় পুরে রাখবে? কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি রানী, এই জীবটিকে বধ করাও যেমন শক্ত, বন্ধ করাও তেমনি। অতএব দিব্য অস্ত্র তােমার হাতে যা আছে তার পরীক্ষা করতে বিলম্ব কোরাে না।

 সন্দীপের মনের ভিতর একটা পরাভবের সংশয় এসেছে বলেই সে আজ এমন অনর্গল বকে গেল। আমার বিশ্বাস, ও জানত আমি অমূল্যকেই ডেকেছি, বেহারা খুব সম্ভব তারই নাম বলেছিল, ও তাকে ফাঁকি দিয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমাকে বলতে দেবার সময় দিলে না যে ওকে ডাকি নি, অমূল্যকে ডেকেছি। কিন্তু আস্ফালন মিথ্যে। এবার দুর্বলকে দেখতে পেয়েছি। এখন আমার জয়লব্ধ জায়গাটির সূচ্যগ্রভূমিও ছাড়তে পারব না।

 আমি বললুম, সন্দীপবাবু আপনি গল্ গল্ করে এত কথা বলে যান কেমন করে? আগে থাকতে বুঝি তৈরি হয়ে আসেন?

 এক মুহূর্তে সন্দীপের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। আমি বললুম, শুনেছি কথকদের খাতায় নানা রকমের লম্বা লম্বা বর্ণনা লেখা থাকে, যখন যেটা যেখানে দরকার খাটিয়ে দেয়। আপনার সেরকম খাতা আছে নাকি?

 সন্দীপ চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, বিধাতার প্রসাদে তােমাদের তাে হাবভাব-ছলাকলার অন্ত নেই; তার উপরেও দর্জির দোকান, স্যাকরার দোকান তােমাদের সহায়; আর বিধাতা কি আমাদেরই এমনি নিরস্ত্র করে রেখেছেন যে—

 আমি বললুম, সন্দীপবাবু, খাতা দেখে আসুন; এ কথাগুলাে ঠিক হচ্ছে না। দেখছি, এক-একবার আপনি উলটোপালটা বলে বসেন। খাতা-মুখস্থর ঐ একটা মস্ত দোষ।

 সন্দীপ আর থাকতে পারলে না। একেবারে গর্জে উঠল, তুমি! তুমি আমাকে অপমান করবে! তােমার কী না আমার ধরা পড়েছে বলাে তাে। তােমার যে—