পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৮৩

জানি নে, আমরা শেষ কথাটাকে জানি নে, এইটেই স্বীকার করা ভালাে—আপনাকেও জানি নে। মানুষ বড়াে আশ্চর্য। তাকে নিয়ে কী প্রকাণ্ড রহস্যই তৈরি হচ্ছে তা সেই রুদ্র দেবতাই জানেন— মাঝের থেকে দগ্ধ হয়ে গেলুম। প্রলয়! প্রলয়ের দেবতাই শিব, তিনিই আনন্দময়, তিনি বন্ধন মােচন করবেন।

 কিছুদিন থেকে বারে বারে মনে হচ্ছে, আমার দুটো বুদ্ধি আছে। আমার একটা বুদ্ধি বুঝতে পারছে, সন্দীপের এই প্রলয়রূপ ভয়ংকর; আর-এক বুদ্ধি বলছে, এই তাে মধুর। জাহাজ যখন ডােবে তখন চার দিকে যারা সাঁতার দেয় তাদের টেনে নেয়— সন্দীপ যেন সেই মরণের মূর্তি— ভয় ধরবার আগেই ওর প্রচণ্ড টান এসে ধরে— সমস্ত আলাে, সমস্ত কল্যাণ থেকে, আকাশের মুক্তি থেকে, নিশ্বাসের বাতাস থেকে, চিরদিনের সঞ্চয় থেকে, প্রতিদিনের ভাবনা থেকে চোখের পলকে একটা নিবিড় সর্বনাশের মধ্যে একেবারে লােপ করে দিতে চায়। কোন্ মহামারীর দূত হয়ে ও এসেছে, অশিবমন্ত্র পড়তে পড়তে রাস্তা দিয়ে চলেছে, আর ছুটে আসছে দেশের সব বালকরা, সব যুবকরা। বাংলাদেশের হৃদয়পদ্মে যিনি মা বসে আছেন তিনি কেঁদে উঠেছেন— তাঁর অমৃতভাণ্ডারের দরজা ভেঙে ফেলে এরা সেখানে মদের ভাণ্ড নিয়ে পানসভা বসিয়েছে; ধুলার উপর ঢেলে ফেলতে চায় সব সুধা, চুরমার করতে চায় চিরদিনের সুধাপাত্র। সবই বুঝলুম, কিন্তু মােহকে তাে ঠেকিয়ে রাখতে পারি নে। সত্যের কঠোর তপস্যার পরীক্ষা করবার জন্যে সত্যদেবেরই এই কাজ। মাতলামি স্বর্গের সাজ প’রে এসে তাপসদের সামনে নৃত্য করতে থাকে। বলে, তােমরা মূঢ়— তপস্যায় সিদ্ধি হয় না, তার পথ দীর্ঘ, তার কাল মন্থর; তাই বজ্রধারী আমাকে পাঠিয়েছেন; আমি তােমাদের বরণ করব; আমি সুন্দরী, আমি মত্ততা, আমার আলিঙ্গনেই নিমেষের মধ্যে সমস্ত সিদ্ধি।

 একটুখানি চুপ করে থেকে সন্দীপ আবার আমাকে বললে, এবার দূরে যাবার সময় এসেছে দেবী! ভালােই হয়েছে। তােমার কাছে আসার কাজ আমার হয়ে গেছে। তার পরেও যদি থাকি তা হলে একে একে আবার সব নষ্ট হয়ে যাবে। পৃথিবীতে যা সকলের চেয়ে বড়াে তাকে লােভে পড়ে সস্তা করতে গেলেই সর্বনাশ ঘটে। মুহূর্তের অন্তরে যা অনন্ত তাকে কালের মধ্যে ব্যাপ্ত করতে গেলেই সীমাবদ্ধ করা হয়। আমরা সেই অনন্তকে নষ্ট করতে বসেছিলুম। ঠিক এমন সময়ে তােমারই বজ্র উদ্যত হল; তােমার পূজাকে তুমি রক্ষা করলে, আর, তােমার এই পূজারীকেও। আজ আমার বিদায়ের