পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৮৫

ঠাকুরপােকে ডেকে পাঠাই, আমাদের সেই ছ হাজার টাকা এখনই বের করে নিয়ে কলকাতায় পাঠাতে হবে, আর দেরি করা নয়।

 এই বলে তিনি চলে যেতেই আমি পিঠের বারকোশ সেইখানে আলগা ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি সেই লােহার সিন্দুকের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম। আমার স্বামীর এমনি ভােলা মন যে দেখি তাঁর যে কাপড়ের পকেটে চাবি থাকে সে কাপড়টা তখনাে আলনায় ঝুলছে। চাবির রিঙ থেকে লােহার সিন্দুকের চাবিটা খুলে আমার জ্যাকেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেললুম।

 এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ল। বললুম, কাপড় ছাড়ছি।

 শুনতে পেলুম মেজোরানী বললেন, এই কিছু আগে দেখি পিঠে তৈরি করছে, আবার এখনই সাজ করবার ধুম পড়ে গেল! কত লীলাই যে দেখব! আজ বুঝি ওদের বন্দে মাতরমের বৈঠক বসবে। ওলাে, ও দেবীচৌধুরানী, লুটের মাল বােঝাই হচ্ছে নাকি?

 কী মনে করে একবার আস্তে আস্তে লােহার সিন্দুকটা খুললুম। বােধ হয় মনে ভাবছিলুম, যদি সমস্তটা স্বপ্ন হয়, যদি হঠাৎ সেই ছােটো দেরাজটা টেনে খুলতেই দেখি সেই কাগজের মােড়কগুলি ঠিক তেমনিই সাজানাে রয়েছে। হায় রে, বিশ্বাসঘাতকের নষ্ট বিশ্বাসের মতােই সব শূন্য।

 মিছামিছি কাপড় ছাড়তেই হল। কোনাে দরকার নেই, তবু নতুন করে চুল বাঁধলুম। মেজোরানীর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন ‘বলি, এত সাজ কিসের’ আমি বললুম, জন্মতিথির।

 মেজোরানী হেসে বললেন, একটা কিছু ছুতাে পেলেই অমনি সাজ। ঢের দেখেছি, তাের মতাে এমন ভাবুনে দেখি নি।

 অমূল্যকে ডাকবার জন্যে বেহারার খোঁজ করছি এমন সময় সে এসে পেনসিলে লেখা একটি ছােটো চিঠি আমার হাতে দিলে। তাতে অমূল্য লিখেছে: দিদি, খেতে ডেকেছিলে কিন্তু সবুর করতে পারলুম না। আগে তােমার আদেশ পালন করে আসি, তার পরে তােমার প্রসাদ গ্রহণ করব। হয়তাে ফিরে আসতে সন্ধ্যা হবে।

 অমূল্য কার হাতে টাকা ফেরাতে চলল, আবার কোন জালের মধ্যে নিজেকে জড়াতে গেল। আমি তাকে তীরের মতাে কেবল ছুঁড়তেই পারি, কিন্তু লক্ষ্য ভুল হলে তাকে আর কোনােমতে ফেরাতে পারি নে।

 এই অপরাধের মূলে যে আমি আছি এই কথাটা এখনই স্বীকার করা আমার উচিত ছিল। কিন্তু, মেয়েরা সংসারে বিশ্বাসের উপরেই বাস করে, সেই-যে তাদের জগৎ। সেই বিশ্বাসকে লুকিয়ে ফাঁকি দিয়েছি, এই কথাটা