পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৮৭

একবার সমস্তটা যথাসাধ্য সেরে-সুরে নিই; অন্তত এই আঘাতটার জন্যে নিজেকে এবং সংসারকে প্রস্তুত করে তুলি। প্রলয়ের বীজ যতক্ষণ মাটির নীচে থাকে ততক্ষণ অনেক সময় নেয়; সে এত সময় যে মনে হয়, ভয়ের বুঝি কোনাে কারণ নেই। কিন্তু মাটির উপর একবার যেই এতটুকু অঙ্কুর দেখা দেয় অমনি দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠে; তখন তাকে কোনােমতে আঁচল দিয়ে, বুক দিয়ে, প্রাণ দিয়ে চাপা দেবার আর সময় পাওয়া যায় না।

মনে করছি, কিছুই ভাবব না, অসাড় হয়ে চুপ করে পড়ে থাকব, তার পরে মাথার উপরে যা এসে পড়ে পড়ুক গে। পরশুদিনের মধ্যেই তাে যা হবার তা হয়ে যাবে— জানাশােনা, হাসাহাসি, কাঁদাকাটি, প্রশ্ন, প্রশ্নের জবাব, সবই।

কিন্তু অমূল্যর সেই আত্মােৎসর্গের-দীপ্তিতে-সুন্দর বালকের মুখখানি যে কিছুতে ভুলতে পারছি নে। সে তাে চুপ করে বসে ভাগ্যের প্রতীক্ষা করে নি, সে যে ছুটে গেল বিপদের মাঝখানে। আমি নারীর অধম তাকে প্রণাম করি— সে আমার বালক-দেবতা, সে আমার কলঙ্কের বােঝা একেবারে খেলাচ্ছলে কেড়ে নিতে এসেছে। সে আমার মার নিজের মাথায় নিয়ে আমাকে বাঁচাবে, ভগবানের এমন ভয়ানক দয়া আমি সইব কেমন করে! বাছা আমার, তােমাকে প্রণাম। ভাই আমার, তােমাকে প্রণাম। নির্মল তুমি, সুন্দর তুমি, বীর তুমি, নির্ভীক তুমি, তােমাকে প্রণাম। জন্মান্তরে তুমি আমার ছেলে হয়ে আমার কোলে এসাে, এই বর আমি কামনা করি।

 এর মধ্যে চার দিকে নানা গুজব জেগে উঠেছে, পুলিস আনাগােনা করছে, বাড়ির দাসী-চাকররা সবাই উদ্‌বিগ্ন। ক্ষেমা দাসী আমাকে এসে বললে, ছােটোরানীমা, আমার এই সােনার পৈঁচে আর বাজুবন্ধ তােমার লােহার সিন্দুকে তুলে রেখে দাও। ঘরের ছােটোরানীই দেশ জুড়ে এই দুর্ভাবনার জাল তৈরি করে নিজে তার মধ্যে আটকা পড়ে গেছে, এ কথা বলি কার কাছে? ক্ষেমার গয়না, থাকোর জমানাে টাকা আমাকে ভালােমানুষের মতাে নিতে হল। আমাদের গয়লানী একটা টিনের বাক্স করে একটি বেনারসি কাপড় এবং তার আর-আর দামি সম্পত্তি আমার কাছে রেখে গেল; বললে, রানীমা, এই বেনারসি কাপড় তােমারই বিয়েতে আমি পেয়েছিলুম।

 কাল যখন আমারই ঘরের লােহার সিন্দুক খােলা হবে তখন এই ক্ষেমা, থাকো, গয়লানী— থাক্, সে কথা কল্পনা করে হবে কী! বরঞ্চ ভাবি, কালকের দিনের পর আর-এক বৎসর কেটে গেছে, আবার একটা তেসরা মাঘের দিন এসেছে। সেদিনও কি আমার সংসারের সব কাটা ঘা এমনি কাটাই থেকে যাবে?