পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৮৯

সেটি ঘুচিয়ে দেবার উপায় আমার হাতে রেখে দিয়েই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন। কী ভালােবাসার দান! কী পাবনমন্ত্র তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন!

 বাক্স খুলে পিস্তলটি বের করে দুই হাতে তুলে আমার মাথায় ঠেকালুম। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে আরতির কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠল। আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলুম।

 রাত্রে লােকজনদের পিঠে খাওয়ানাে গেল। মেজোরানী এসে বললেন, নিজে নিজেই খুব ধুম করে জন্মতিথি করে নিলি যা হােক! আমাদের বুঝি কিছু করতে দিবি নে? এই বলে তিনি তাঁর সেই গ্রামােফোনটাকে যত রাজ্যের নটীদের মিহি চড়া সুরের দ্রুত তানের কসরত শােনাতে লাগলেন; মনে হতে লাগল, যেন গন্ধর্বলােকের সুরওয়ালা ঘােড়ার আস্তাবল থেকে চিঁহি চিঁহি শব্দে হ্রেষাধ্বনি উঠছে।


খাওয়ানাে শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল, আজ রাতে আমার স্বামীর পায়ের ধুলাে নেব। শােবার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি অকাতরে ঘুমােচ্ছেন। আজ সমস্ত দিন তাঁর অনেক ঘােরাঘুরি অনেক ভাবনা গিয়েছে। খুব সাবধানে মশারি একটুখানি খুলে তাঁর পায়ের কাছে আস্তে আস্তে মাথা রাখলুম। চুলের স্পর্শ লাগতেই ঘুমের ঘােরে তিনি তাঁর পা দিয়ে আমার মাথাটা একটু ঠেলে দিলেন।

 পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে বসলুম। দূরে একটা শিমুল গাছ অন্ধকারে কঙ্কালের মতাে দাঁড়িয়ে আছে; তার সমস্ত পাতা ঝরে গিয়েছে; তারই পিছনে সপ্তমীর চাঁদ ধীরে ধীরে অস্ত গেল।

 আমার হঠাৎ মনে হল, আকাশের সমস্ত তারা যেন আমাকে ভয় করছে, রাত্রিবেলাকার এই প্রকাণ্ড জগৎ আমার দিকে যেন আড় চোখে চাইছে। কেননা, আমি যে একলা। একলা মানুষের মতাে এমন সৃষ্টিছাড়া আর কিছুই নেই। যার সমস্ত আত্মীয়স্বজন একে একে মরে গিয়েছে সেও একলা নয়, মৃত্যুর আড়াল থেকে সে সঙ্গ পায়। কিন্তু যার সমস্ত আপন মানুষ পাশেই রয়েছে তবু কাছে নেই, সে মানুষ পরিপূর্ণ সংসারের সকল সঙ্গ থেকেই একেবারে খসে পড়ে গিয়েছে, মনে হয়, যেন অন্ধকারে তার মুখের দিকে চাইলে সমস্ত নক্ষত্রলােকের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি যেখানে রয়েছি সেইখানেই নেই। যারা আমাকে ঘিরে রয়েছে আমি তাদের কাছ থেকেই দূরে। আমি চলছি, ফিরছি, বেঁচে আছি এবং একটা বিশ্বব্যাপী বিচ্ছেদের উপরে, যেন পদ্মপাতার উপরকার শিশিরবিন্দুর মতাে।