পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
২০৫

 যাওয়ার চেয়ে না-যাওয়াটাই বেশি লজ্জা বলে স্বামীর সঙ্গে বাইরে গেলুম। বৈঠকখানার ঘরে সন্দীপ দাঁড়িয়ে দেয়ালে-টাঙানাে ছবি দেখছিল। আমরা যেতেই বলে উঠল, তােমরা ভাবছ, লােকটা ফেরে কেন? সৎকার সম্পূর্ণ শেষ না হলে প্রেত বিদায় হয় না।

 এই বলে চাদরের ভিতর থেকে সে একটা রুমালের পুঁটুলি বের করে টেবিলের উপরে খুলে ধরলে। সেই গিনিগুলাে। বললে, নিখিল, ভুল কোরাে না। ভেবাে না, হঠাৎ তােমাদের সংসর্গে পড়ে সাধু হয়ে উঠেছি। অনুতাপের অশ্রুজল ফেলতে ফেলতে এই ছ হাজার টাকার গিনি ফিরিয়ে দেবার মতাে ছিঁচকাদুনে সন্দীপ নয়। কিন্তু—

 এই বলে সন্দীপ কথাটা আর শেষ করলে না। একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে চেয়ে বললে, মক্ষীরানী, এতদিন পরে সন্দীপের নির্মল জীবনে একটা কিন্তু এসে ঢুকেছে। রাত্রি তিনটের পর জেগে উঠেই রােজ তার সঙ্গে একবার ঝুটোপুটি লড়াই করে দেখেছি, সে নিতান্ত ফাঁকি নয়, তার দেনা চুকিয়ে না দিয়ে সন্দীপেরও নিষ্কৃতি নেই। সেই আমার সর্বনাশিনী কিন্তুর হাতে দিয়ে গেলুম আমার পূজা। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখলুম, পৃথিবীতে কেবলমাত্র তারই ধন আমি নিতে পারব না— তােমার কাছে আমি নিঃস্ব হয়ে তবে বিদায় পাব দেবী! এই নাও।

 বলে সেই গয়নার বাক্সটিও বের করে টেবিলের উপর রেখে সন্দীপ দ্রুত চলে যাবার উপক্রম করলে। আমার স্বামী তাকে ডেকে বললেন, শুনে যাও সন্দীপ!

 সন্দীপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললে, আমার সময় নেই নিখিল। খবর পেয়েছি মুসলমানের দল আমাকে মহামূল্য রত্নের মতাে লুঠ করে নিয়ে তাদের গােরস্থানে পুঁতে রাখবার মতলব করেছে। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার দরকার। উত্তরের গাড়ি ছাড়তে আর পঁচিশ মিনিট মাত্র আছে। অতএব, এখনকার মতাে চললুম। তার পরে আবার একটু অবকাশ পেলে তােমাদের সঙ্গে বাকি সমস্ত কথা চুকিয়ে দেব। যদি আমার পরামর্শ নাও, তুমিও বেশি দেরি কোরাে না। মক্ষীরানী, বন্দে প্রলয়রূপিণীং হৃৎপিণ্ডমালিনীং।

 এই বলে সন্দীপ প্রায় ছুটে চলে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলুম। গিনি আর গয়নাগুলাে যে কত তুচ্ছ সে আর-কোনাে দিন এমন করে দেখতে পাই নি। কত জিনিস সঙ্গে নেব, কোথায় কী ধরাব, এই কিছু আগে তাই ভাবছিলুম। এখন মনে হল, কোনাে জিনিসই নেবার দরকার নেই, কেবল বেরিয়ে চলে যাওয়াটাই দরকার।