পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
২০৭

 অন্ধকার হয়ে এল। দূর গ্রামে আগুন লাগলে থেকে থেকে যেমন তার শিখা আকাশে লাফিয়ে উঠতে থাকে তেমনি বহু দূর থেকে এক-একবার এক-একটা কলরবের ঢেউ অন্ধকারের ভিতর থেকে যেন কেঁপে উঠতে লাগল।

 ঠাকুরঘর থেকে সন্ধ্যারতির শঙ্খ ঘণ্টা বেজে উঠল। আমি জানি, মেজোরানী সেই ঘরে গিয়ে জোড়হাত করে বসে আছেন। আমি এই রাস্তার ধারের জানলা ছেড়ে এক পা কোথাও নড়তে পারলুম না। সামনেকার রাস্তা, গ্রাম, আরাে দূরেকার শস্যশূন্য মাঠ এবং তারও শেষ প্রান্তে গাছের রেখা ঝাপসা হয়ে এল। রাজবাড়ির বড়াে দিঘিটা অন্ধের চোখের মতাে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। বাঁ দিকের ফটকের উপরকার নহবৎখানাটা উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা দেখতে পাচ্ছে।

 রাত্রিবেলাকার শব্দ যে কত রকমের ছদ্মবেশ ধরে তার ঠিকানা নেই। কাছে কোথায় একটা ডাল নড়ে, মনে হয় দূরে যেন কে ছুটে পালাচ্ছে। হঠাৎ বাতাসে একটা দরজা পড়ল, মনে হল সেটা যেন সমস্ত আকাশের বুক ধড়াস্ করে ওঠার শব্দ। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারের কালাে গাছের সারের নীচে দিয়ে আলাে দেখতে পাই, তার পরে আর দেখতে পাই নে। ঘােড়ার পায়ের শব্দ শুনি, তার পরে দেখি ঘােড়-সােয়ার রাজবাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে ছুটে চলেছে।

 কেবলই মনে হতে লাগল, আমি মরলেই সব বিপদ কেটে যাবে। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি সংসারকে আমার পাপ নানা দিক থেকে মারতে থাকবে। মনে পড়ল, সেই পিস্তলটা বাক্সের মধ্যে আছে। কিন্তু এই পথের ধারের জানলা ছেড়ে পিস্তল নিতে যেতে পা সরল না, আমি যে আমার ভাগ্যের প্রতীক্ষা করছি।

 রাজবাড়ির দেউড়ির ঘণ্টায় ঢং ঢং করে দশটা বাজল।

 তার খানিক পরে দেখি রাস্তায় অনেকগুলি আলাে, অনেক ভিড়। অন্ধকারে সমস্ত জনতা এক হয়ে জুড়ে গিয়ে মনে হল, একটা প্রকাণ্ড কালাে অজগর এঁকেবেঁকে রাজবাড়ির গেটের মধ্যে ঢুকতে আসছে।

 দেওয়ানজি দূরে লােকের শব্দ শুনে গেটের কাছে ছুটে গেলেন। সেই সময় একজন সওয়ার এসে পৌঁছতেই দেওয়ানজি ভীতস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, জটাধর, খবর কী?

 সে বললে, খবর ভালাে নয়।

 প্রত্যেক কথা উপর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলুম।