পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১২
ঘরে-বাইরে

করা। এবং যখন কোনাে-একটা উদ্দেশ্যই লােকে প্রত্যাশা করছে তখন সেটা নেই বললেই কথাটা স্পর্ধার মতাে শুনতে হয়।

 কিন্তু অনেক সময় উদ্দেশ্য বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায়। হরিণের গায়ে চিহ্ন আছে কেন হরিণ তা জানে না, কিন্তু হরিণ সম্বন্ধে যাঁরা বই লেখেন তাঁরা বলেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই-সমস্ত চিহ্নের দ্বারা বনের আলােছায়ার সঙ্গে সে বেমালুম মিশিয়ে থাকতে পারবে।

 এই আন্দাজ সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্যটা যে হরিণের মনের নয় সে কথা সকলকেই মানতে হবে।

 উদ্দেশ্য হরিণের নয়, কিন্তু হরিণের ভিতর দিয়ে বিশ্বকর্মার একটা উদ্দেশ্য তাে প্রকাশ পাচ্ছে। তা হয়তাে পাচ্ছে। তেমনি যে কালে লেখক জন্মগ্রহণ করেছে সেই কালটি লেখকের ভিতর দিয়ে হয়তাে আপন উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তুলেছে। তাকে উদ্দেশ্য নাম দিতে পারি বা না পারি এ কথা বলা চলে যে, লেখকের কাল লেখকের চিত্তের মধ্যে গােচরে ও অগােচরে কাজ করছে।

 আমি বলছি, এ কাজও শিল্পকাজ; শিক্ষাদানের কাজ নয়। কাল আমাদের মনের মধ্যে তার নানা রঙের সুতােয় জাল বুনছে, সেই তার সৃষ্টি; আমি তার থেকে যদি কিছু আদায় করতে চাই তবে সে উদ্দেশ্য আমারই।

 আমাদের দেশের আধুনিক কাল গােপনে লেখকের মনে যেসব রেখাপাত করেছে ঘরে-বাইরে গল্পের মধ্যে তার ছাপ পড়েছে। কিন্তু এই ছাপার কাজ শিল্পকাজ। এর ভিতর থেকে যদি কোনাে সুশিক্ষা বা কুশিক্ষা আদায় করবার থাকে সেটা লেখকের উদ্দেশ্যের অঙ্গ নয়।

 পৃথিবীর খুব একজন বড়াে লেখকের লেখা সামনে ধরা যাক। শেক্সপীয়রের ওথেলাে। কবিকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় তাঁর উদ্দেশ্য কী, তিনি মুশকিলে পড়বেন। ভেবে চিন্তে যদি বা কোনাে উত্তর দেন, নিশ্চয়ই সেটা ভুল উত্তর হবে।

 আমি যদি ব্রাহ্মণসভার সভ্য হই তবে আমি ঠিক করব, কবির উদ্দেশ্য বর্ণভেদ বাঁচিয়ে চলা সম্বন্ধে জগৎকে সদুপদেশ দেওয়া। যদি স্বাধীন জেনেনার বিরুদ্ধ-পক্ষ হই তা হলে বলব, পরপুরুষের মুখদর্শন পরিহার করতে বলাই কবির পরামর্শ।

 কিংবা কবির বুদ্ধি বা ধর্মজ্ঞানের প্রতি যদি আমার সন্দেহ থাকে তা হলে বলব, একনিষ্ঠ পাতিব্রত্যের নিদারুণ পরিণাম দেখিয়ে তিনি সতীত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। কিংবা ইয়াগাের চাতুরীকেই শেষ পর্যন্ত জয়ী করে তুলে সরলতার প্রতি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ প্রকাশ করাই তাঁর মতলব।