পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রন্থপরিচয়
২১৩

 কিন্তু সােজা কথা হচ্ছে, তিনি নাটক লিখেছেন। সেই নাটকে কবির ভালাে-লাগা, মন্দলাগা, এমন-কি কবির দেশ-কালও প্রকাশ পায়, কিন্তু সেটা তত্ত্ব বা উপদেশরূপে নয়, শিল্পরূপেই। অর্থাৎ সমস্ত নাটকের অবিচ্ছিন্ন প্রাণ এবং লাবণ্য-রূপে। যেমন একজন বাঙালিকে যখন দেখি তখন মানুষটার সঙ্গে তার জাতিকে, তার বাপ-দাদাকে সম্মিলিত করে দেখি; তার ব্যক্তি এবং তার জাতি দুইয়ের মাঝখানে কোনাে জোড়ের চিহ্ন থাকে না; এও তেমনি। কবির কাব্যে স্বাতন্ত্রের সঙ্গে আর তার দেশকালের সঙ্গে একটা প্রাণগত সম্মিলন আছে।

 তাই বলছিলুম, ঘরে-বাইরে গল্প যখন লেখা যাচ্ছে তখন তার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের সাময়িক অভিজ্ঞতা জড়িত হয়ে পড়েছে এবং লেখকের ভালাে-মন্দ-লাগাটাও বােনা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই রঙিন সুতােগুলাে শিল্পেরই উপকরণ। তাকে যদি অন্য কোনাে উদ্দেশ্যে প্রয়ােগ করা যায় তবে সে উদ্দেশ্য লেখকের নয়, পাঠকের। শৌখিন লােকে চমরির পুচ্ছ থেকে চামর তৈরি করে; কিন্তু চমরি জানে তার পুচ্ছটা প্রাণের অন্তর্গত— ওটাকে কেটে নিয়ে চামর করা অন্তত তার উদ্দেশ্য নয়, যে করে তারই।

গল্পের মত

তার পরে কথা হচ্ছে, আমার হৃদয়ভাবের সঙ্গে পাঠকের হৃদয়ভাবের যখন বিরােধ ঘটল তখন পাঠক আমাকে দণ্ড দিতে বাধ্য।

 মাটির উপর পড়ে গেলে শিশু যেমন মাটিকে মারে তেমনি এমন স্থলে সাধারণ পাঠকে দণ্ড দিয়ে থাকে, এ কথা আমার বিশেষরূপ জানা। তাই বলে দণ্ড যে দিতেই হবে এমন কোনাে কথা নেই। ভূতকে না ভয় করতে পারি, এমন-কি, ভূতের ভয় অনিষ্টকর মনে করতে পারি, তবু ভূতের ভয়ের গল্প পড়বার সময়ে সে কথা মনে রাখবার দরকার নেই। এখানে মতামতের কথা নয়, রসের অনুভূতির কথা। খ্রিস্টান রসিক যখন কোনাে হিন্দু আর্টিস্টের আঁকা দেবীমূর্তির বিচার করেন তখন তিনি যদি বুঝতে পারেন যে তিনি মিশনারি তা হলেই ভালাে, যদি না পারেন তবে সেজন্যে হিন্দু আর্টিস্টকে দোষ দেওয়া চলবে না। কারণ হিন্দু আর্টিস্ট স্বভাবতই আপন মত বিশ্বাস সংস্কার অনুসারে ছবি আঁকবেই। কিন্তু যেহেতু সেটা ছবি সেইজন্যেই তার মধ্যে মত বিশ্বাস সংস্কারের অতীত একটি জিনিস থাকবে, সেটি হচ্ছে রস; সে রস যদি অহিন্দুর অগ্রাহ্য হয় তবে হয় রসবােধের অভাবে সেটা অহিন্দুর দোষ, নয় রসের অভাবে সেটা হিন্দু