পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রন্থপরিচয়
২১৫

 উত্তর এই, আখ্যায়িকাটি অধিকাংশ গল্পের আখ্যায়িকার মতোই আমার কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু এইটুকুমাত্র বললেই লেখিকার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেওয়া হয় না। ঐ প্রশ্নের মধ্যে একটি কথা চাপা আছে যে, এমন ঘটনা প্রাচীন হিন্দুপরিবারে অসম্ভব।

 ঠিক একটা গল্পের ঘটনা সেই গল্পের অনুরূপ অবস্থার মধ্যেই ঘটতে পারে, আর কোথাও ঘটতে পারে না— প্রাচীন বা নবীন, হিন্দু বা অহিন্দু কোনো পরিবারেই না। অতএব কোনো বিশেষ পরিবারে কী ঘটেছে সে কথা স্মরণ করে গুজব করাই চলে, গল্প লেখা চলে না। মানবচরিত্রে যে-সমস্ত সম্ভবপরতা আছে সেইগুলিকেই ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে গল্পে নাটকে বিচিত্র করে তোলা হয়। মানবচরিত্রের মধ্যে চিরন্তনত্ব আছে, কিন্তু ঘটনার মধ্যে নেই। ঘটনা নানা আকারে নানা জায়গায় ঘটে, একই ঘটনা দুই জায়গায় ঠিক একইরকম ঘটে না। কিন্তু তার মূলে যে মানবচরিত্র আছে সে চিরকালই নিজেকে প্রকাশ করে এসেছে। এইজন্য এই মানবচরিত্রের প্রতিই লেখক দৃষ্টি রাখেন, কোনো ঘটনার নকল করার প্রতি নয়।

সাহিত্যবিচার

তা হলে প্রশ্ন এই যে, প্রাচীন হিন্দুপরিবারে সর্বত্রই মানবচরিত্র কি মনুসংহিতার রাশ মেনে চলে? কখনো লাগাম ছিঁড়ে খানার মধ্যে গিয়ে পড়ে না?

 আমরা বৈদিক পৌরাণিক কাল থেকে এইটেই দেখে আসছি যে, বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুলের লড়াইয়ের অন্ত নেই। এক দিকে শাসনও কড়া, অন্য দিকে মানবের প্রকৃতিও উদ্দাম; তাই কখনো শাসন জেতে, কখনো প্রকৃতি। এই লড়াই যদি প্রাচীন হিন্দুপরিবারে সম্পূর্ণ অসম্ভব হয় তবে সেই প্রাচীন হিন্দুপরিবারের ঠিকানা এখনো পাওয়া যায় নি। তা ছাড়া এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক, যেখানে মন্দ একেবারেই নেই সেখানে ভালোেও নেই। প্রাচীন হিন্দুপরিবারে কারো পক্ষে মন্দ হওয়া যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে সেই পরিবারের লোক ভালোও নয়, মন্দও নয়, তারা সংহিতার ‘কলের পুতুল’। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে মানুষ ভাললাকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়, এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।

 প্রাচীন সংস্কৃত উদ্ভট কবিতায় যে-সকল কুৎসিত স্ত্রীনিন্দা দেখতে পাই বর্তমান কোনো পাশ্চাত্যশিক্ষাভিমানীর লেখায় তার আভাসমাত্র পাওয়া যায় না। তার কারণ, আধুনিক কবিরা স্ত্রীজাতিকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে থাকেন। এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, সেই-সকল প্রাচীন স্ত্রীনিন্দাগুলি স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে