পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৬
ঘরে-বাইরে

মিথ্যা, কিন্তু যদি স্ত্রীবিশেষ সম্বন্ধেও মিথ্যা হয় তবে সেই কবিতাগুলির উদ্‌ভব হল কোথা থেকে?

 তা হলে বােধ হয় তর্কটা এইরকম দাঁড়াবে; মানবপ্রকৃতির মধ্যে নিয়ম লঙ্ঘন করবার একটা বেগ আছে, কিন্তু সেটা কি সাহিত্যে বর্ণনা করবার বিষয়? এ তর্কের উত্তর আবহমান কালের সমস্ত সাহিত্যই দিচ্ছে, অতএব আমি নিরুত্তর থাকলেও ক্ষতি হবে না।

 দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে অধিকাংশ সমালােচকের হাতে সাহিত্যবিচার স্মৃতিশাস্ত্রবিচারের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বঙ্কিমের কোন্ নায়িকা ‘হিন্দুরমণী’ হিসাবে কতটা উৎকর্ষ প্রকাশ করেছে তাই নিয়ে সমালােচক-মহলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ চলে থাকে। ভ্রমর তার স্বামীর প্রতি অভিমান করেছিল সেটাতে তার হিন্দুসতীত্বে কতটা খাদ ধরা পড়েছে, সূর্যমুখী স্বামীর প্রেয়সী সতিনকে নিজেরও প্রেয়সী করতে না পারাতে তার হিন্দুরমণীত্বের কতটা লাঘব হয়েছে, শকুন্তলা কী আশ্চর্য হিন্দুনারী, দুষ্যন্ত কী আশ্চর্য হিন্দুরাজা, এই-সকল বিচার-প্রহসন আমাদের দেশে সাহিত্যবিচারের নাম ধরে নিজের গাম্ভীর্য বাঁচিয়ে চলতে পারে— জগতে আর কোথাও এমন দেখা যায় না। শেক্‌স্‌পীয়র অনেক নায়িকার সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে ইংরেজ-রমণীত্ব কতটা প্রকট হয়েছে এ নিয়ে কেউ চিন্তা করে না, এমন-কি, তাদের খ্রিস্টানির মাত্রা নিক্তির ওজনে পরিমাপ করে পয়লা দোসরা মার্কা দেওয়া খ্রিস্টান পাদ্রিদের দ্বারাও ঘটা সম্ভব নয়।

 আমি হয়তাে এ কথা বলে ভালাে করলুম না। কেননা, জগতে যা কোথাও নেই সেইটেই ভারতে আছে, এই হচ্ছে আধুনিক বাঙালির গর্ব। কিন্তু ভারত তাে বাঙালির সৃষ্টি নয়, আমরা সাহিত্য-সমালােচনা শুরু করবার পূর্বেও ভারতবর্ষ ছিল। সেই ভারতের অলংকারশাস্ত্রে নায়িকা-বিচার মনুপরাশরের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয় নি, মানবচরিত্রের বৈচিত্র্য-অনুসারেই তাদের শ্রেণীবিভাগের চেষ্টা হয়েছিল। আমি এরকম শ্রেণীবিভাগ ভালাে বলি নে। কারণ, সাহিত্য তাে বিজ্ঞান নয়; সাহিত্যে শ্রেণীর ছাঁচে নায়ক-নায়িকার ঢালাই হতে থাকলে সেটা পুতুলের রাজ্য হয়, প্রাণের রাজ্য হয় না। তবু যদি নিতান্তই শ্রেণীবিভাগের শখ সাহিত্যেও মেটাতে হয় তা হলে ধর্মশাস্ত্রনির্দিষ্ট হিন্দু ও অহিন্দু এই দুই শ্রেণী না ধরে যথাসম্ভব মানবস্বভাবের বৈচিত্র্য অনুসারে শ্রেণীবিভাগ করা কর্তব্য।