পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রন্থপরিচয়
২১৭

স্বদেশপ্রেম

লেখিকার কাছে আমার শেষ নিবেদন এই যে, গল্পের ভিতর থেকে গল্পের চেয়ে বেশি কিছু যদি আদায় করতেই হয় তা হলে অন্তত গল্পের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর-একটি কথা এই যে, আমিও দেশকে ভালােবাসি, তা যদি না হত তা হলে দেশের লােকের কাছে লােকপ্রিয় হওয়া আমার পক্ষে কঠিন হত না। সত্য প্রেমের পথ আরামের নয়, সে পথ দুর্গম সিদ্ধিলাভ সকলের শক্তিতে নেই এবং সকলের ভাগ্যেও ফলে না, কিন্তু দেশের প্রেমে যদি দুঃখ ও অপমান সহ্য করি তা হলে মনে এই সান্ত্বনা থাকবে যে, কাঁটা বাঁচিয়ে চলবার ভয়ে সাধনায় মিথ্যাচারণ করি নি। দুঃখ পাই তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু আমার সকলের চেয়ে বেদনার বিষয় এই যে, যা সত্য মনে করি তাকে প্রকাশ করতে গিয়ে লেখিকার মতাে অনেক সরল শ্রদ্ধাবান স্বদেশবৎসল ও সকরুণ হৃদয়ে বেদনা দিয়েছি। সে আমার দুর্ভাগ্য, কিন্তু সে আমার অপরাধ নয়।

—সবুজ পত্র। অগ্রহায়ণ। ১৩২২

ঘরে-বাইরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইবার পর বহুকাল পর্যন্ত ইহার বিরুদ্ধ সমালােচনা চলিয়াছিল। ১৩২৬ সালের চৈত্র মাসের প্রবাসীতে ‘সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে স্বীয় বক্তব্য প্রকাশ করেন; নিম্নে তাহা মুদ্রিত হইল—

সাহিত্যবিচার

ঘরে-বাইরে উপন্যাসখানা লইয়া বাংলার পাঠক-মহলে এখনাে কথা চলিতেছে। হৃদয়াবেগ যখন অত্যন্ত প্রবল হয় তখন মানুষ গদ্য ছাড়িয়া পদ্য ধরে। সম্প্রতি তাহারও সূচনা প্রকাশ পাইতেছে। এক জায়গায় দেখিলাম, ঘরে-বাইরে সম্বন্ধে ক্ষোভ চোদ্দ অক্ষরের লাইনে লাইনে রক্তবর্ণ হইয়া ফুটিয়াছে। ইহাতে পদ্যসাহিত্যের বিপদ চিন্তা করিয়া উদ্‌বিগ্ন হইলাম। পাছে ইহা সংক্রামক হইয়া পড়ে, সেইজন্য এ সম্বন্ধে উদাসীন থাকিতে পারিলাম না।

 পছন্দ লইয়া মানুষের সঙ্গে তর্ক চলে না। ভর্তৃহরির অনেক পূর্ব হইতেই কবিরা এ সম্বন্ধে অবস্থাবিশেষে হাল ছাড়িয়া বসিয়া আছেন। স্বয়ং কালিদাসও কবিতাই লিখিয়াছেন, কিন্তু দিঙ্‌নাগাচার্যের সহিত বাদ-প্রতিবাদ করেন নাই। সাধারণত কবিদের নিন্দা-অসহিষ্ণু বলিয়া খ্যাতি আছে; কিন্তু সেই অসহিষ্ণুতা লইয়া (দুই-একজন ছাড়া) তাঁহারা নিজেরাই ক্ষোভ অনুভব করিয়াছেন, সাহিত্যকে ক্ষুব্ধ করিয়া তােলেন নাই। যখন তাঁহাদের লেখার প্রতি কেহ