পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৮
ঘরে-বাইরে

কলঙ্ক আরােপ করিয়াছে তখন সেই কলঙ্কভঞ্জনের ভার তাঁহারা কালের হস্তেই সমর্পণ করিয়াছেন। তাহাদের মধ্যে যাঁহারা ভাগ্যবান তাঁহাদের লেখা সম্বন্ধে ইহাই প্রমাণ হইয়া গেছে যে, তাঁহাদের রচনার কলসে আলংকারিক ছিদ্র, একটা কেন, একশােটা থাকিতে পারে, কিন্তু তবু তাহা হইতে রস বাহির হইয়া যায় নাই; সাহিত্যে এই কলঙ্কভঞ্জনের পালা অনেক দিন হইতে অনেকবার অভিনীত হইয়াছে, যাঁহারা আলংকারিক তাহাদের গঞ্জনা হইতে কবিরা বার বার রক্ষা পাইয়াছেন।

 ঘরে-বাইরে সম্বন্ধে রসবােধ লইয়া যদি কথা উঠিত তবে সে কথা যতই কটু হউক নীরব থাকিতাম। কিন্তু যে কথা উঠিয়াছে তাহা সাহিত্যসীমানার বাহিরের জিনিস। তাহা যুক্তির অধিকারের মধ্যে, সুতরাং তাহা লইয়া তর্ক চলে, এবং তর্ক না চালাইলে কর্তব্যপালন করা হয় না; কারণ, যাহা অন্যায় তাহাকে সহ্য করিয়া গেলে সাধারণের প্রতি অন্যায় করা হয়।

 ঘরে-বাইরে বাহির হইবার পরেই আমার বিরুদ্ধে একটা নালিশ শােনা গেল যে, আমি এই উপন্যাসে সীতার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করিয়াছি। কথাটা এতই অদ্ভুত যে আমি আশা করিয়াছিলাম যে, এমন-কি, আমাদের দেশেও ইহা গ্রাহ্য হইবে না। কিন্তু দেখিলাম, লােকে উৎসাহের সহিত ইহা গ্রহণ করিয়াছে, এবং জনগণের নিন্দায় একদা সীতা যেরূপ নির্বাসিত হইয়াছিলেন এ গ্রন্থও সেইরূপ গণ্যমান্যদের সভা ও লাইব্রেরি ঘরের টেবিল হইতে নির্বাসিত হইতে থাকিল।

 এটাকে সামান্য ব্যক্তিগত হিসাবে দেখিলে ইহাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কিন্তু যে-কোনাে প্রভাবে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে বিকৃত করে সেই প্রভাব যদি ব্যাপক হইয়া উঠিতে থাকে, তবে সেটাকে সাধারণের পক্ষে ক্ষতিজনক বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। অতএব ঘরে-বাইরে গ্রন্থের যে অপরাধ বানাইয়া তুলিয়া আমার প্রতি কেবলই আক্রোশবর্ষণ চলিতেছে সেই অপরাধের অভিযােগটাকে বিশ্লেষণ করিয়া দেখা দরকার।

 মহাকাব্যে নাটকে বা নভেলে যে আখ্যানবস্তু পাওয়া যায় তাহার নানা বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু সকল বৈচিত্র্যসত্ত্বেও সেই-সমস্ত আখ্যানে একটি সাধারণ উপাদান দেখিতে পাই; সেটি আর কিছু নয়, সংসারে ভালাে-মন্দের দ্বন্দ্ব। তাই রামায়ণে দেখিয়াছি রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতে দেখিয়াছি কুরু-পাণ্ডবের বিরােধ। কেবলই সমস্তই একটানা ভালাে, কোথাও মন্দের কোনাে আভাসমাত্র নাই, এমনতরাে নিছক চিনির শরবত দিয়াই সাহিত্যের ভােজ সম্পন্ন করা অন্তত কোনাে বড়াে যজ্ঞে দেখি নাই।