পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রন্থপরিচয়
২১৯

 এত বড়াে মােটা কথাও যে আমাকে আজ বিশেষ করিয়া বলিতে হইতেছে সেজন্য আমি সংকোচ বােধ করিতেছি। শিশুরা যে রূপকথা শােনে সেই রূপকথাতেও রাক্ষস আছে; সেই রাক্ষস শুদ্ধ সংযত হইয়া কেবলই মনুসংহিতা আওড়ায় না, সে বলে ‘হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ’। ধর্মনীতির দিক হইতে দেখিলে তাহার পক্ষে এমন কথা বলা নিঃসন্দেহই গুরুতর অপরাধ। আশা করি, যাহারা এই-সকল গল্প রচনা করিয়াছিল তাহারা নরমাংসাশী ছিল না এবং যাহারা এই-সব গল্প শােনে নরমাংসে তাহাদের স্পৃহা বাড়ে না। তাই বলিতেছি, মানুষের গন্ধে গল্পের রাক্ষসের লুব্ধতা উদ্রেক হওয়া ধর্মশাস্ত্রমতে অপরাধ সন্দেহ নাই, কিন্তু মানুষের গন্ধে গল্পের রাক্ষসের ভ্রাতৃপ্রেম যদি জাগিয়া উঠিত এবং সে যদি সুমধুর স্বরে বলিয়া উঠিত ‘অহিংসা পরমাে ধর্মঃ’ তবে সাহিত্যরসনীতি-অনুসারে রাক্ষসের সে অপরাধ কিছুতে ক্ষমা করা চলিত না। কোনাে শিশুর কাছে ইহার পরীক্ষা করিয়া দেখিলেই এক মুহূর্তেই আমার কথা সপ্রমাণ হইবে। কিন্তু সেই শিশুই কি বড়াে হইয়া এম. এ. পাস করিবামাত্র গল্পের রাক্ষসটা মরাল্-ফিলজফির নীচে চাপা পড়িয়া সরু সুরে শান্তিশতক আওড়াইতে থাকিবে?

 যাই হউক, সকল ভাষার সকল সাহিত্যেই ভালাে মন্দ দুই-রকম চরিত্রেরই মানুষ আসরে স্থান পায়। পুণ্যভূমি ভারতবর্ষেও সেইরূপ বরাবর চলিয়া আসিয়াছে। এইজন্যই ঘরে-বাইরে নভেলে যখন সন্দীপের অবতারণা করিয়াছিলাম তখন মুহূর্তের জন্যও আশঙ্কা করি নাই যে, সেটা লইয়া আমাদের দেশের উপাধিধারী এক গণ্যমান্য লােকের কাছে আমাকে এমন জবাবদিহির দায়ে পড়িতে হইবে। এখন হইতে ভবিষ্যতে এই আশঙ্কা মনে রাখিব, কিন্তু স্বভাব সংশােধন করিতে পারিব না; কেননা আমাদের দেশের বর্তমান কাল ছাড়াও কাল আছে এবং গণ্যমান্য লােক ছাড়াও লােক আছে, তাহারা নিশ্চয়ই রাক্ষসের মুখ হইতে এই অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা শুনিতে চায়— হাঁউ মাঁউ খাঁউ! মানুষের গন্ধ পাঁউ! চন্দ্রবিন্দুর বাহুল্য প্রয়ােগেও তাহারা বাংলা ভাষা সম্বন্ধে উদ্‌বিগ্ন হইবে না।

 জানি আমাকে প্রশ্ন করা হইবে, সন্দীপ যত বড়াে মন্দ লােকই হউক তাহাকে দিয়া সীতাকে অপমান কেন? আমি কৈফিয়ত-স্বরূপে বাল্মীকির দোহাই মানিব। তিনি কেন রাবণকে দিয়া সীতার অপমান ঘটাইলেন? তিনি তাে অনায়াসেই রাবণকে দিয়া বলাইতে পারিতেন যে, ‘মালক্ষ্মী, আমি বিশ হাতে তােমার পায়ের ধুলা লইয়া দশ ললাটে তিলক কাটিতে আসিয়াছি।’ বেদব্যাস কেন দুঃশাসনকে দিয়া, জয়দ্রথকে দিয়া, দ্রৌপদীকে অপমানিত করিয়াছেন?