পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২০
ঘরে-বাইরে

রাবণ রাবণের যােগ্যই কাজ করিয়াছে, দুঃশাসন জয়দ্রথ যাহা করিয়াছে তাহা তাহাদিগকেই সাজে। তেমনি আমার মতে, সন্দীপ সীতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছে তাহা সন্দীপেরই যােগ্য; অতএব সে কথা অন্যায় কথা বলিয়াই তাহা সংগত হইয়াছে। এবং সেই সংগতি সাহিত্যে নিন্দার বিষয় নহে।

 যদি আধুনিক কালের কোনাে উপাধিধারী এমন কথা গদ্যে বা পদ্যে বলিতে পারিতেন যে, রাবণের পক্ষে সীতাহরণ কাজটা অসংগত, মন্থরার পক্ষে রামের প্রতি ঈর্ষা অযথা, সূর্পনখার পক্ষে লক্ষ্মণের প্রতি অনুরাগের উদ্রেক অসম্ভব, তাহা হইলে নিশ্চয় কবিগুরু বিচারসভায় হাজির থাকিলেও নিরুত্তর থাকিতেন; কেননা এমন-সকল আলােচনা সাহিত্যসভায় চলিতে পারে। কিন্তু তাহা না বলিয়া ইহারা যদি বলিতেন, এ-সকল বর্ণনা নিন্দনীয়, কারণ ইহাতে সীতাকে রামকে লক্ষ্মণকে অপমানিত করা হইয়াছে এবং এই অপমান স্বয়ং কবিকৃত অপমান, ধর্মশাস্ত্র-অনুসারে এই-সকল ভালােমানুষের প্রতি সকলেরই সাধু ব্যবহার করাই উচিত, তবে যে কবি সর্বাঙ্গে কীটের উৎপাত স্তব্ধ হইয়া সহ্য করিয়াছিলেন তিনিও বােধ হয় বিচলিত হইয়া উঠিতেন।

 আমি অন্য দেশের কবি ও লেখকের গ্রন্থ হইতে কোনাে দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিলাম না। কেননা এমন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত যে, অন্য দেশের সহিত ভারতবর্ষের কোনাে অংশে মিল নাই, সেই অমিলটাকেই প্রাণপণে আঁকড়াইয়া থাকা আমাদের ন্যাশনাল সাহিত্যের লক্ষণ— অর্থাৎ ন্যাশনাল সাহিত্য কুপমণ্ডুকের সাহিত্য।

—প্রবাসী। চৈত্র ১৩২৬

শ্রীঅমিয় চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে (২৯ ফাল্গুন ১৩২২) ঘরে-বাইরে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন—

 প্রমথ চৌধুরী এই গল্পটিকে রূপক বলে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু সে বােধ হয় কতকটা লীলাচ্ছলেই করে থাকবেন। এর মধ্যে কোনাে জ্ঞানকৃত রূপকের চেষ্টা নেই, এ কেবলমাত্র গল্প। মানুষের অন্তরের সঙ্গে বাইরের এবং একের সঙ্গে অন্যের ঘাতপ্রতিঘাতে যে হাসিকান্না উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এর মধ্যে তারই বর্ণনা আছে। তার চেয়ে বেশি যদি কিছু থাকে সেটা অবান্তর এবং আকস্মিক।