পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
ঘরে-বাইরে

 সে তো সম্ভব নয়। কিন্তু কেন বলো দেখি।

 আমার ইচ্ছা আমি নিজে উপস্থিত থেকে তাঁকে খাওয়াব।

 শুনে আমার স্বামী আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এর পূর্বে অনেক দিন অনেকবার তিনিই তাঁর বন্ধুদের কাছে আমাকে বের হবার জন্যে অনুরোধ করেছেন। আমি কিছুতেই রাজি হই নি।

 আমার স্বামী আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে একরকম করে চাইলেন— আমি তার মানেটা ঠিক বুঝলুম না। ভিতরে হঠাৎ একটু কেমন লজ্জা বোধ হল। বললুম, না না, সে কাজ নেই।

 তিনি বললেন, কেনই-বা কাজ নেই! আমি সন্দীপকে বলব—— যদি কোনোরকমে সম্ভব হয় তা হলে কাল সে থেকে যাবে।

 দেখলুম সম্ভব হল।

 আমি সত্য কথা বলব। সেদিন আমার মনে হচ্ছিল, ঈশ্বর কেন আমাকে আশ্চর্য সুন্দর করে গড়লেন না? কারো মন হরণ করবার জন্যে যে তা নয়। কিন্তু রূপ যে একটা গৌরব। আজ এই মহাদিনে দেশের পুরুষেরা দেশের নারীর মধ্যে দেখুক একবার জগদ্ধাত্রীকে। কিন্তু বাইরের রূপ না হলে তাদের চোখ যে দেবীকে দেখতে পায় না। সন্দীপবাবু কি আমার মধ্যে দেশের এই জাগ্রত শক্তিকে দেখতে পাবেন? না মনে করবেন এ একজন সামান্য মেয়েমানুষ, তাঁর এই বন্ধুর ঘরের গৃহিণীমাত্র?

 সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার এই সুদীর্ঘ কালো চুল একটি লাল রেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোঁপা করে বাঁধবার সময় ছিল না। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজি শাড়ি, আর জরির একটুখানি পাড় দেওয়া হাত-কাটা জ্যাকেট।

 আমি ঠিক করেছিলুম এ খুব সংযত সাজ, এর চেয়ে সাদাসিধা আর কিছু হতে পারে না। এমন সময় আমার মেজো জা এসে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তার পরে ঠোঁটদুটো খুব টিপে একটু হাসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদি, তুমি হাসলে যে?

 তিনি বললেন, তোর সাজ দেখছি।

 আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললুম, এমনিই কী সাজ দেখলে?

 তিনি আর-একবার একটুখানি বাঁকা হাসি হেসে বললেন, মন্দ হয় নি, ছোটোরানী, বেশ হয়েছে। কেবল ভাবছি, সেই তোমার বিলিতি দোকানের বুককাটা জামাটা পরলেই সাজটা পুরোপুরি হত।