পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮
ঘরে-বাইরে

ঝোঁক ছিল, তবুও যে এত কষ্ট করে সত্য রক্ষা করলেন এ আমার কম পুরস্কার নয়।

 আমি ভালো করে জবাব দিতে পারি নি; মুখ লাল করে ঘেমে একটা সোফার কোণে বসে পড়লুম। দেশের মূর্তিমতী নারীশক্তির মতো যেরকম নিঃসংকোচে এবং সগৌরবে সন্দীপবাবুর কাছে বেরিয়ে কেবলমাত্র দর্শনদানের দ্বারা তাঁর ললাটে জয়মাল্য পরাব কল্পনা করেছিলুম, এ পর্যন্ত তার কিছুই হল না।

 সন্দীপবাবু ইচ্ছা করেই আমার স্বামীর সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে দিলেন। তিনি জানেন, তর্কে তার তীক্ষ্ণধার মনের সমস্ত উজ্জ্বলতা ঝক্ঝক্ করে উঠতে থাকে। এর পরেও আমি বার বার দেখেছি, আমি উপস্থিত থাকলেই তিনি তর্ক করবার সামান্য উপলক্ষটুকুও ছাড়তেন না।

 ‘বন্দে মাতরম মন্ত্র সম্বন্ধে আমার স্বামীর মত কী তিনি জানতেন; সেইটের উল্লেখ করে বললেন, দেশের কাজে মানুষের কল্পনাবৃত্তির যে একটা জায়গা আছে সেটা কি তুমি মান না, নিখিল?

 একটা জায়গা আছে মানি, কিন্তু সব জায়গাই তার তা মানি নে। দেশজিনিসকে আমি খুব সত্যরূপে নিজের মনে জানতে চাই এবং সকল লোককে জানাতে চাই— এত বড়ো জিনিসের সম্বন্ধে কোনো মনভোলাবার জাদুমন্ত্র ব্যবহার করতে আমি ভয়ও পাই, লজ্জাও বোধ করি।

 তুমি যাকে মায়ামন্ত্র বলছ আমি তাকেই বলি সত্যি। আমি দেশকে সত্যই দেবতা বলে মানি। আমি নরনারায়ণের উপাসক—— মানুষের মধ্যেই। ভগবানের সত্যকার প্রকাশ, তেমনি দেশের মধ্যে।

 এ কথা যদি সত্যই বিশ্বাস কর তবে তোমার পক্ষে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সুতরাং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ভেদ নেই।

 সে কথা সত্য, কিন্তু আমার শক্তি অল্প, অতএব নিজের দেশের পূজার দ্বারাই আমি দেশনারায়ণের পূজা করি।

 পূজা করতে নিষেধ করি নে, কিন্তু অন্য দেশে যে নারায়ণ আছেন তাঁর প্রতি বিদ্বেষ করে সে পূজা কেমন করে সমাধা হবে?

 বিদ্বেষও পূজার অঙ্গ। কিরাতবেশী মহাদেবের সঙ্গে লড়াই করেই অর্জুন বরলাভ করেছিলেন। আমরা এক দিক দিয়ে ভগবানকে মারব, একদিন তাতেই তিনি প্রসন্ন হবেন।

 তাই যদি হয় তবে যারা দেশের ক্ষতি করছে আর যারা দেশের সেবা করছে উভয়েই তাঁর উপাসনা করছে তা হলে বিশেষ করে দেশভক্তি প্রচার করবার দরকার নেই।