পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
ঘরে-বাইরে

 বিমল কী উত্তর দেবে প্রথমটা ভেবে পেল না। একটু পরে বললে, দুরকমেই দেশের কাজ হতে পারে। চার দিকে ঘুরে কাজ করা কিংবা এক জায়গায় বসে কাজ করা, সেটা নিজের ইচ্ছা কিংবা স্বভাব-অনুসারে বেছে। নিতে হবে। ওর মধ্যে যেভাবে কাজ করা আপনার মন চায় সেইটেই আপনার পথ।

 সন্দীপ বললে, তবে সত্য কথা বলি। এতদিন বিশ্বাস ছিল, ঘুরে ঘুরে সমস্ত দেশকে মাতিয়ে বেড়ানোই আমার কাজ। কিন্তু নিজেকে ভুল বুঝেছিলুম। ভুল বুঝবার একটা কারণ ছিল এই যে, আমার অন্তরকে সব সময় পূর্ণ রাখতে পারে এমন শক্তির উৎস আমি কোনো-এক জায়গায় পাই নি। তাই কেবল দেশে দেশে নতুন নতুন লোকের মনকে উত্তেজিত করে সেই উত্তেজনা থেকেই আমাকে জীবনের তেজ সংগ্রহ করতে হত। আজ আপনিই আমার কাছে দেশের বাণী। এ আগুন তো আজ পর্যন্ত আমি কোনো পুরুষের মধ্যে দেখি নি। ধিক্‌, এতদিন আপন শক্তির অভিমান করেছিলুম। দেশের নায়ক হবার গর্ব আর রাখি নে। আমি উপলক্ষমাত্র হয়ে আপনার এই তেজে এইখানে থেকেই সমস্ত দেশকে জ্বালিয়ে তুলতে পারব, এ আমি স্পর্ধা করে বলতে পারি। না না, আপনি লজ্জা করবেন না— মিথ্যা লজ্জা সংকোচ বিনয়ের অনেক উপরে আপনার স্থান। আপনি আমাদের মউচাকের মক্ষীরানী। আমরা আপনাকে চারি দিকে ঘিরে কাজ করব। কিন্তু সেই কাজের শক্তি আপনারই— তাই আপনার থেকে দূরে গেলেই আমাদের কাজ কেন্দ্রভ্রষ্ট, আনন্দহীন হবে। আপনি নিঃসংকোচে আমাদের পূজা গ্রহণ করুন।

 লজ্জায় এবং গৌরবে বিমলের মুখ লাল হয়ে উঠল এবং চায়ের পেয়ালায় চা ঢালতে তার হাত কাঁপতে লাগল।

চন্দ্রনাথবাবু আর-এক দিন এসে বললেন, তোমরা দুজনে কিছুদিনের জন্যে একবার দার্জিলিং বেড়াতে যাও— তোমার মুখ দেখে আমার বোধ হয় তোমার শরীর ভালো নেই। ভালো ঘুম হয় না বুঝি?

 বিমলকে সন্ধ্যার সময় বললুম, বিমল, দার্জিলিঙে বেড়াতে যাবে?

 আমি জানি, দার্জিলিঙে গিয়ে হিমালয় পর্বত দেখবার জন্যে বিমলের খুব শখ ছিল। সেদিন সে বললে, না, এখন থাক্।

 দেশের ক্ষতি হবার আশঙ্কা ছিল।

 আমি বিশ্বাস হারাব না, আমি অপেক্ষা করব। ছোটো জায়গা থেকে