পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৫৫

নানা রঙে রাঙিয়েছে, নানা সাজে সাজিয়েছে, নানা নামে পুজো দিয়েছে। কিন্তু মেয়েরা? তােমরাই দেহ দিয়ে মন দিয়ে পৃথিবীতে রক্তমাংসের বাস্তবকে চেয়েছ, বাস্তবকে জন্ম দিয়েছ, বাস্তবকে পালন করেছ।

 মক্ষী শিক্ষিত মেয়ে, সহজে তর্ক করতে ছাড়ে না। বলল, তাই যদি সত্যি হত তা হলে পুরুষ কি মেয়েকে পছন্দ করতে পারত?

 আমি বললুম, মেয়েরা সেই বিপদের কথা জানে, তারা জানে পুরুষ-জাতটা স্বভাবতই ফাঁকি ভালােবাসে; সেইজন্যে তারা পুরুষের কাছ থেকেই কথা ধার করে ফাঁকি সেজে পুরুষকে ভােলাবার চেষ্টা করে। তারা জানে খাদ্যের চেয়ে মদের দিকেই স্বভাব-মাতাল পুরুষ-জাতটার ঝোঁক বেশি, এইজন্যেই নানা কৌশলে নানা ভাবে-ভঙ্গিতে তারা নিজেকে মদ বলেই চালাতে চায়; আসলে তারা যে খাদ্য সেটা যথাসাধ্য গােপন করে রাখে। মেয়েরা বস্তুতন্ত্র, তাদের কোনাে মােহের উপকরণের দরকার করে না— পুরুষের জন্যেই তাে যত রকম-বেরকমের মােহের আয়ােজন। মেয়েরা মােহিনী হয়েছে নেহাত দায়ে পড়ে।

 মক্ষী বললে, তবে এ মােহ ভাঙতে চান কেন?

 আমি বললুম, স্বাধীনতা চাই বলে। দেশের স্বাধীনতা চাই, মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধেও স্বাধীনতা চাই। দেশ আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে আমি কোনাে নীতিকথার ধোঁয়ায় তাকে এতটুকু আড়াল করে দেখতে পারব না। আমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, তুমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে মাঝখানে কেবল কতকগুলাে কথা ছড়িয়ে মানুষের কাছে মানুষকে দুর্গম দুর্বোধ করে তােলার ব্যবসায় আমি একটুও পছন্দ করি নে।

 আমার মনে ছিল যে লােক ঘুমােতে ঘুমােতে চলছে তাকে হঠাৎ চমকিয়ে দেওয়া কিছু নয়। কিন্তু আমার স্বভাবটা যে দুর্দাম, ধীরে সুস্থে চলা আমার চাল নয়। জানি, যে কথা সেদিন বললুম, তার ভঙ্গিটা তার সুরটা বড়াে সাহসিক। জানি, এরকম কথার প্রথম আঘাত কিছু দুঃসহ। কিন্তু মেয়েদের কাছে সাহসিকেরই জয়। পুরুষরা ভালােবাসে ধোঁয়াকে, আর মেয়েরা ভালােবাসে বস্তুকে। সেইজন্যেই পুরুষ পুজো করতে ছােটে তার নিজের আইডিয়ার অবতারকে, আর মেয়েরা তাদের সমস্ত অর্ঘ্য এনে হাজির করে প্রবলের পায়ের তলায়।

 আমাদের কথাটা যখন ঠিক গরম হয়ে উঠতে চলেছে এমন সময় আমাদের ঘরের মধ্যে নিখিলের ছেলেবেলাকার মাস্টার চন্দ্রনাথবাবু এসে উপস্থিত। মোটের উপরে পৃথিবী জায়গাটা বেশ ভালােই ছিল। কিন্তু এই-সব মাস্টার-