পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬০
ঘরে-বাইরে

চেয়ে বড়ো ভুল করা হয়, এ কথা বোঝবার জোর ওর নেই। আইডিয়ায় মানুষকে যে কত কাহিল করে তার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত হল নিখিল। ওরকম পুরুষমানুষ আর দ্বিতীয় দেখি নি। ও নিতান্তই প্রকৃতির একটা খেয়াল। ওকে নিয়ে একটা ভদ্ররকমের গল্প কি নাটক গড়াও চলে না, ঘর করা তো দূরের কথা।

 তার পরে মক্ষী— বেশ বোধ হচ্ছে আজকে ওর ঘোর ভেঙে গেছে। ও যে কোন্ স্রোতে ভেসেছে হঠাৎ আজ সেটা বুঝতে পেরেছে। এখন ওকে জেনেশুনে হয় ফিরতে হবে নয় এগোতে হবে। তা নয়, এখন থেকে ও একবার এগোবে একবার পিছোবে। তাতে আমার ভাবনা নেই। কাপড়ে যখন আগুন লাগে তখন ভয়ে যতই ছুটোছুটি করে আগুন ততই বেশি করে জ্বলে ওঠে। ভয়ের ধাক্কাতেই ওর হৃদয়ের বেগ আরো বেশি করে বেড়ে উঠবে। আরো তো এমন দেখেছি। সেই তো বিধবা কুসুম ভয়েতে কাঁপতে কাঁপতেই আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিল। আর, আমাদের হস্টেলের কাছে যে ফিরিঙ্গি মেয়ে ছিল সে আমার উপরে রাগ করলে এক-এক দিন মনে হত সে আমাকে রেগে যেন ছিঁড়ে ফেলে দেবে! সেদিনকার কথা আমার বেশ মনে আছে যেদিন সে চিৎকার করে ‘যাও যাও’ বলে আমাকে ঘর থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিলে— তার পরে যেমনি আমি চৌকাঠের বাইরে পা বাড়িয়েছি অমনি সে ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মূর্ছিত হয়ে পড়ল। ওদের আমি খুব জানি। রাগ বল, ভয় বল, লজ্জা বল, ঘৃণা বল, এ-সমস্তই জ্বালানি কাঠের মতো ওদের হৃদয়ের আগুনকে বাড়িয়ে তুলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে জিনিস এ আগুনকে সামলাতে পারে সে হচ্ছে আইডিয়াল। মেয়েদের সে বালাই নেই। ওরা পুণ্যি করে, তীর্থ করে, গুরুঠাকুরের পায়ের কাছে গড় হয়ে প্রণাম করে, আমরা যেমন করে আপিস করি— কিন্তু আইডিয়ার ধার দিয়ে যায় না।

 আমি নিজের মুখে ওকে বেশি কিছু বলব না— এখনকার কালের কতকগুলো ইংরেজি বই ওকে পড়তে দেব। ও ক্রমে ক্রমে বেশ স্পষ্ট করে বুঝতে পারুক যে, প্রবৃত্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে মডার্‌ন্। প্রবৃত্তিকে লজ্জা করা, সংযমকে বড়ো জানাটা মডার্‌ন্‌ নয়। ‘মডার্‌ন্‌’ এই কথাটার যদি আশ্রয় পায় তা হলেই ও জোর পাবে। কেননা, ওদের তীর্থ চাই, গুরুঠাকুর চাই, বাঁধা সংস্কার চাই— শুধু আইডিয়া ওদের কাছে ফাঁকা।