পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৬৩

 ঐ দেখাে, আবার গাম্ভীর্য! কাকে বলছ নর্দমা, কাকে বলছ ঘােলা জল? ও-সব হল রাগের কথা। তুমি রাগ করবে বলেই জগতে এক জিনিস আর হবে না? বিমল যদি তােমার না হয় তাে সে তােমার নয়ই, যতই চাপাচাপি রাগারাগি করবে ততই ঐ কথাটাই আরাে বড়াে করে প্রমাণ হবে। বুক ফেটে যায় যে! তা যাক। তাতে বিশ্ব দেউলে হবে না, এমন-কি, তুমিও দেউলে হবে না। জীবনে মানুষ যা-কিছু হারায় তার সকলের চেয়েও মানুষ অনেক বেশি বড়াে; সমস্ত কান্নার সমুদ্র পেরিয়েও তার পার আছে। এইজন্যেই সে কাঁদে, নইলে কাঁদতও না।

 কিন্তু সমাজের দিক থেকে—

 সে-সব কথা সমাজ ভাবুক গে, যা করতে হয় করুক। আমি কাঁদছি আমার আপন কান্না, সমাজের কান্না নয়। বিমল যদি বলে সে আমার স্ত্রী নয়, তা হলে আমার সামাজিক স্ত্রী যেখানে থাকে থাক্‌, আমি বিদায় হলুম।

 দুঃখ তাে আছেই। কিন্তু, একটা দুঃখ বড়াে মিথ্যে হবে, সেটা থেকে নিজেকে যে ক’রে পারি বাঁচাবই। কাপুরুষের মতাে এ কথা মনে করতে পারব না যে, অনাদরে আমার জীবনের দাম কমে গেল। আমার জীবনের মূল্য আছে, সেই মূল্য দিয়ে আমি কেবল আমার ঘরের অন্তঃপুরটুকু কিনে রাখবার জন্যে আসি নি। আমার যা বড়াে ব্যবসা সে কিছুতেই দেউলে হবে না, আজ এই কথাটা খুব সত্য করে ভাববার দিন এসেছে।

 আজ যেমন নিজেকে তেমনি বিমলকেও সম্পূর্ণ বাইরে থেকে দেখতে হবে। এতদিন আমি আমারই মনের কতকগুলি দামি আইডিয়াল দিয়ে বিমলকে সাজিয়েছিলুম। আমার সেই মানসী মূর্তির সঙ্গে সংসারে বিমলের সব জায়গায় যে মিল ছিল তা নয়, কিন্তু তবুও আমি তাকে পূজা করে এসেছি আমার মানসীর মধ্যে।

 সেটা আমার গুণ নয়, সেইটেই আমার মহদ্‌দোষ। আমি লােভী আমি আমার সেই মানসী তিলােত্তমাকে মনে মনে ভােগ করতে চেয়েছিলুম, বাইরের বিমল তার উপলক্ষ হয়ে পড়েছিল। বিমল যা সে তাইই— তাকে যে আমার খাতিরে তিলােত্তমা হতেই হবে এমন কোনাে কথা নেই। বিশ্বকর্মা আমারই ফর্মাশ খাটছেন নাকি?

 তা হলে আজ একবার আমাকে সমস্ত পরিষ্কার করে দেখে নিতে হবে। মায়ার রঙে যে-সব চিত্রবিচিত্র করেছি, সে আজ খুব শক্ত করে মুছে ফেলব। এতদিন অনেক জিনিস আমি দেখেও দেখি নি। আজ এ কথা স্পষ্ট বুঝেছি,