পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
ঘরে-বাইরে

 তবু আমার এই রক্তে-মাংসে এই ভাবে-ভাবনায় গড়া বীণাটা ওরই হাতে বাজতে লাগল। সেই হাতটাকে আমি ঘৃণা করতে চাই এবং এই বীণাটাকে— কিন্তু বীণা তো বাজল। আর, সেই সুরে যখন আমার দিন-রাত্রি ভরে উঠল। তখন আমার আর দয়ামায়া রইল না। এই সুরের রসাতলে তুমিও মজো, আর তােমার যা-কিছু আছে সব মজিয়ে দাও, এই কথা আমার শিরার প্রত্যেক কম্পন, আমার রক্তের প্রত্যেক ঢেউ আমাকে বলতে লাগল।

 এ কথা আর বুঝতে বাকি নেই যে আমার মধ্যে একটা কিছু আছে যেটা— কী বলব— যার জন্যে মনে হয় আমার মরে যাওয়াই ভালাে।

 মাস্টারমশায় যখন একটু ফাঁক পান আমার কাছে এসে বসেন। তাঁর একটা শক্তি আছে, তিনি মনটাকে এমন একটা শিখরের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন যেখান থেকে নিজের জীবনের পরিধিটাকে এক মুহূর্তেই বড়াে করে দেখতে পাই। বরাবর যেটাকে সীমা বলে মনে করে এসেছি তখন দেখি সেটা সীমা নয়।

 কিন্তু, কী হবে? আমি অমন করে দেখতেই চাই নে। যে নেশায় আমাকে পেয়েছে সেই নেশাটা ছেড়ে যাক, এমন ইচ্ছাও যে আমি সত্য করে করতে পারি নে। সংসারের দুঃখ ঘটুক, আমার মধ্যে আমার সত্য পলে-পলে কালাে হয়ে মরুক, কিন্তু আমার এই নেশা চিরকাল টিঁকে থাক, এই ইচ্ছা যে কিছুতেই ছাড়তে পারছি নে। আমার ননদ মুনুর স্বামী তখন মদ খেয়ে মুনুকে মারত, তার পরে মেরে অনুতাপে হাউ হাউ করে কাঁদত, শপথ করে বলত ‘আর কখনাে মদ ছোঁব না’, আবার তার পরদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মদ নিয়ে বসত— দেখে আমার সর্বাঙ্গ রাগে ঘৃণায় জ্বলত। আজকে দেখি আমার মদ খাওয়া যে তার চেয়ে ভয়ানক। এ মদ কিনে আনতে হয় না, গ্লাসে ঢালতে হয় না— রক্তের ভিতর থেকে আপনা-আপনি তৈরি হয়ে উঠছে। কী করি! এমনি করেই কি জীবন কাটবে!

 এক-একবার চমকে উঠে আপনার দিকে তাকাই আর ভাবি আমি আগাগােড়া একটা দুঃস্বপ্ন; এক সময়ে হঠাৎ দেখতে পাব এ-আমি সত্য নয়। যে ভয়ানক অসংলগ্ন, এর যে আগের সঙ্গে গােড়ার মিল নেই, এ যে মায়াজাদুকরের মতাে কালাে কলঙ্ককে ইন্দ্রধনুর রঙে রঙে রঙিন করে তুলেছে। এ যে কী হল, কেমন করে হল, কিছুই বুঝতে পারছি নে।

 একদিন আমার মেজো জা এসে হেসে বললেন, আমাদের ছােটোরানীর গুণ আছে! অতিথিকে এত যত্ন, সে যে ঘর ছেড়ে এক তিল নড়তে চায় না! আমাদের সময়েও অতিথিশালা ছিল, কিন্তু অতিথির এত বেশি আদর