পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৭৩

সন্দীপবাবু, আপনি দেশের কী কাজ আছে বলে আমাকে ডেকেছেন, তাই আমার ঘরের কাজ ফেলে এসেছি।

 তিনি একটু হেসে বললেন, আমি তাে সেই কথাই আপনাকে বলছিলুম। আমি যে পূজার জন্যেই এসেছি তা জানেন? আপনার মধ্যে আমি আমার দেশের শক্তিকেই প্রত্যক্ষ দেখতে পাই, সে কথা কি আপনাকে বলি নি? ভূগােলবিবরণ তাে একটা সত্য বস্তু নয়! শুধু সেই ম্যাপটার কথা স্মরণ করে কি কেউ জীবন দিতে পারে? যখন আপনাকে সামনে দেখতে পাই তখনই তাে বুঝতে পারি, দেশ কত সুন্দর, কত প্রিয়, প্রাণে তেজে কত পরিপূর্ণ! আপনি নিজের হাতে আমার কপালে জয়টিকা পরিয়ে দেবেন, তবেই তাে জানব, আমি আমার দেশের আদেশ পেয়েছি। তবেই তাে সেই কথা স্মরণ করে লড়তে লড়তে মৃত্যুবাণ খেয়ে যদি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি তবে বুঝব, সে কেবলমাত্র ভূগােলবিবরণের মাটি নয়, সে একখানা আঁচল। কেমন আঁচল জানেন? আপনি সেদিন সেই-যে একখানি শাড়ি পরেছিলেন, লাল মাটির মতাে তার রঙ, আর তার চওড়া পাড় একটি রক্তের ধারার মতাে রাঙা, সেই শাড়ির আঁচল। সে কি আমি কোনােদিন ভুলতে পারব। এইসব জিনিসই তাে জীবনকে সতেজ, মৃত্যুকে রমণীয় করে তােলে।

 বলতে বলতে সন্দীপের দুই চোখ জ্বলে উঠল। চোখে সে ক্ষুধার আগুন কি পূজার সে আমি বুঝতে পারলুম না। আমার সেইদিনের কথা মনে পড়ল যেদিন আমি প্রথম ওঁর বক্তৃতা শুনেছিলুম। সেদিন, তিনি অগ্নিশিখা না মানুষ সে আমি ভুলে গিয়েছিলুম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতাে ব্যবহার করা চলে; তার অনেক কায়দা-কানুন আছে। কিন্তু আগুন যে আর-এক জাতের; সে এক নিমেষে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, প্রলয়কে সুন্দর করে তােলে। মনে হতে থাকে, যে সত্য প্রতিদিনের শুকনাে কাঠে হেলাফেলার মধ্যে লুকিয়ে ছিল সে আজ আপনার দীপ্যমান মূর্তি ধরে চারি দিকের সমস্ত কৃপণের সঞ্চয়গুলােকে অট্টহাস্যে দগ্ধ করতে ছুটে চলেছে।

 এর পরে আমার কিছু বলবার শক্তি ছিল না। আমার ভয় হতে লাগল, এখনই সন্দীপ ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরবেন। কেননা তাঁর হাত চঞ্চল আগুনের শিখার মতােই কাঁপছিল, আর তাঁর চোখের দৃষ্টি আমার উপর যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতাে এসে পড়ছিল।

 সন্দীপ বলে উঠলেন, আপনারা সব ছােটো ছােটো ঘােরাে নিয়মকেই কি বড়াে করে তুলবেন? আপনাদের এমন প্রাণ আছে যার একটু আভাসেই আমরা জীবনমরণকে তুচ্ছ করতে পারি। সে কি কেবল অন্দরের ঘােমটা-মােড়া