পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৭৫

ঝাঁটা-পেটা করে দূর করে দেব। দেখাে দেখি, এই সক্কালবেলায় তােমার বৈঠকখানার আসর মাটি করে দিলে! ক্ষেমারও আচ্ছা আক্কেল দেখছি, জানে তার মনিব বাইরের বাবুর সঙ্গে একটু গল্প করছে— একেবারে সেখানে গিয়ে উপস্থিত— লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বসেছে! তা, ছােটোরানী, এ-সব ঘরকন্নার কথায় তুমি থেকো না। তুমি বাইরে যাও, আমি যেমন করে পারি সব মিটিয়ে দিচ্ছি।


আশ্চর্য মানুষের মন! এক মুহূর্তের মধ্যেই তার পালে এমন উলটো হাওয়া লাগে! এই সকালবেলায় ঘরকন্না ফেলে বাইরে সন্দীপের সঙ্গে বৈঠকখানায় আলাপ-আলােচনা করতে যাওয়া আমার চিরকালের অন্তঃপুরের অভ্যস্ত আদর্শে এমনি সৃষ্টিছাড়া বলে মনে হল যে আমি কোনাে উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে এলুম।

 নিশ্চয় জানি, ঠিক সময় বুঝে মেজোরানী নিজে থাকোকে টিপে দিয়ে ক্ষেমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়েছেন। কিন্তু আমি এমনি টলমলে জায়গায় আছি যে এ-সব নিয়ে কোনাে কথাই কইতে পারি নে। এই তাে সেদিন নন্‌কু দরােয়ানকে ছাড়িয়ে দেবার জন্যে প্রথম ঝাঁজে আমার স্বামীর সঙ্গে যেরকম উদ্ধতভাবে ঝগড়া করেছিলুম শেষ পর্যন্ত তা টিঁকল না। দেখতে দেখতে নিজের উত্তেজনাতেই নিজের মধ্যে একটা লজ্জা এল। এর মধ্যে আবার মেজোরানী এসে আমার স্বামীকে বললেন, ঠাকুরপাে, আমারই অপরাধ। দেখাে ভাই, আমরা সেকেলে লােক, তােমার ঐ সন্দীপবাবুর চাল-চলন কিছুতেই ভালাে ঠেকে না। সেইজন্যে ভালাে মনে করেই আমি দরােয়ানকে— তা, এতে যে ছােটোরানীর অপমান হবে এ কথা মনেও করি নি, বরঞ্চ ভেবেছিলুম উলটো। হায় রে পােড়া কপাল, আমার যেমন বুদ্ধি!

 এমনি করে দেশের দিক থেকে, পূজার দিক থেকে, যে কথাটাকে এত উজ্জ্বল করে দেখি সেইটেই যখন নীচের দিক থেকে এমন করে ঘুলিয়ে উঠতে থাকে তখন প্রথমটা হয় রাগ, তার পরেই মনে গ্লানি আসে।

 আজ শােবার ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে জানলার কাছে বসে বসে ভাবতে লাগলুম, চার দিকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জীবনটা আসলে কতই সরল হতে পারে। ঐ-যে মেজোরানী নিশ্চিন্তমনে বারান্দায় বসে সুপুরি কাটছেন, ঐ সহজ আসনে বসে সহজ কাজের ধারা আমার কাছে আজ দুর্গম হয়ে উঠল! রােজ রােজ নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, এর শেষ কোনখানে? আমি কি মরে যাব, সন্দীপ কি চলে যাবে, এ-সমস্তই কি রােগীর প্রলাপের