পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
ঘরে-বাইরে

থামানাে; আমি গড়ের বাদ্যটাকেই বাহাল রাখব, সানাই আমাদের সর্বনাশ করেছে। প্রবৃত্তির যে জয়পতাকা আমাদের হাতে দিয়ে মা প্রকৃতি, মা শক্তি, মা মহামায়া রণক্ষেত্রে আমাদের পাঠিয়েছেন তাকে আমরা লজ্জা দেব না। প্রবৃত্তিই সুন্দর, প্রবৃত্তিই নির্মল, যেমন নির্মল ভূঁইচাপা ফুল, যে কথায় কথায় স্নানের ঘরে ভিনােলিয়া সাবান মাখতে ছােটে না।

 একটা প্রশ্ন কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে, কেন বিমলের সঙ্গে জীবনটাকে জড়িয়ে ফেলতে দিচ্ছি? আমার জীবনটা তাে ভেসে-যাওয়া কলার ভেলা নয় যে যেখানে-সেখানে ঠেকতে ঠেকতে চলবে।

 সেই কথাই তাে বলছিলুম, যে একটিমাত্র আইডিয়ার ছাঁচে জীবনটাকে পরিমিত করতে চাই জীবন তাকে ছাপিয়ে যায়। থেকে থেকে মানুষ ছিটকে ছিটকে পড়ে। এবার আমি যেন বেশি দূরে ছিটকে পড়েছি।

 বিমল যে আমার কামনার বিষয় হয়ে উঠেছে সেজন্যে আমার কোনাে মিথ্যে লজ্জা নেই। আমি যে স্পষ্ট দেখছি ও আমাকে চায়। ঐ তাে আমার স্বকীয়া। গাছে ফল বোঁটায় ঝুলে আছে। সেই বোঁটার দাবিকেই চিরকালের বলে মানতে হবে নাকি? ওর যত রস, যত মাধুর্য, সে যে আমার হাতে সম্পূর্ণ খসে পড়বার জন্যেই। সেইখানেই একেবারে আপনাকে ছেড়ে দেওয়াই ওর সার্থকতা; সেই ওর ধর্ম, ওর নীতি। আমি সেইখানেই ওকে পেড়ে আনব, ওকে ব্যর্থ হতে দেব না।

 কিন্তু আমার ভাবনা এই যে, আমি জড়িয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে, আমার জীবনে বিমল বিষম একটা দায় হয়ে উঠবে। আমি পৃথিবীতে এসেছি কর্তৃত্ব করতে। আমি লােককে চালনা করব কথায় এবং কাজে। সেই লােকের ভিড়ই আমার যুদ্ধের ঘােড়া। আমার আসন তার পিঠের উপরে, তার রাশ আমার হাতে। তার লক্ষ্য সে জানে না, শুধু আমিই জানি। কাঁটায় তার পায়ে রক্ত পড়বে, কাদায় তার গা ভরে যাবে; তাকে বিচার করতে দেব না— তাকে ছােটাব।

 সেই আমার ঘােড়া আজ দরজায় দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে! তার হ্রেষাধ্বনিতে সমস্ত আকাশ আজ কেঁপে উঠল। কিন্তু আমি করছি কী! দিনের পর দিন আমার কী নিয়ে কাটছে। ও দিকে আমার এমন শুভদিন যে বয়ে গেল!

 আমার ধারণা ছিল, আমি ঝড়ের মতাে ছুটে চলতে পারি। ফুল ছিঁড়ে আমি মাটিতে ফেলে দিই, কিন্তু তাতে আমার চলার ব্যাঘাত করে না। কিন্তু,